Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Baghbazar Fire

তিন মাসের ছেলের গায়ে বস্তা জড়িয়েই রাতভর রাস্তায়

ছেলেকে শাশুড়ির কোলে দিয়ে টাকার ব্যাগটা বার করে আনার জন্য ঢোকার চেষ্টা করি, কিন্তু পুলিশ যেতে দেয়নি।

অনিশ্চয়তায়: ছেলেকে নিয়ে সুনীতা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

অনিশ্চয়তায়: ছেলেকে নিয়ে সুনীতা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

সুনীতা প্রামাণিক
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৪১
Share: Save:

নিজে মোটা সোয়েটার পরেছি, তার উপরে কম্বল চাপিয়েছি। সদ্য আনা চালের বস্তা খালি করে কোলের সন্তানের গায়ে চাপিয়েছি সেই বস্তাই! ঠান্ডা থেকে বাঁচতে নয়, আগুনে পুড়ে যাওয়ার ভয়ে। প্রাণে বাঁচার পরেও তিন মাসের ছেলের গায়ে বস্তা জড়িয়েই রাতভর রাস্তায় কাটাই। চব্বিশ ঘণ্টা ওই ভাবে রাস্তায় কাটানোর পরেও জানি না আমাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ কী! এখনও চোখের সামনে ভাসছে, গত রাতের সেই প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়।

আমি কৃষ্ণনগরের মেয়ে। হাজার বস্তির গোবিন্দ প্রামাণিকের সঙ্গে বছরখানেক হল আমার বিয়ে হয়েছে। আমাদের ছেলে শুভজিতের তিন মাস বয়স। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর, ভাশুর নিয়ে সাত জনের সংসারে প্রবল টানাটানি। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বাগবাজার এলাকার কয়েকটি বাড়িতে কাজ নিতে হয়েছে। প্রতিদিনের মতো বুধবার সন্ধ্যাতেও কাজ সেরে ফিরে ছেলেকে নিয়ে সবে খাওয়াতে বসেছিলাম আমি। হঠাৎ শুনি, বাইরে আগুন-আগুন চিৎকার। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝিনি। হঠাৎ প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ। শাশুড়ি ছুটে এসে বলেন, ‘‘সিলিন্ডার ফাটছে। বেরিয়ে এসো।’’ আমাদের ঠিক পিছনের ঘরেও তখন সিলিন্ডার ফাটল। আর দেরি করিনি। নিজে মোটা সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে চালের বস্তা ফাঁকা করে ফেলি। সেই বস্তা দিয়েই তিন মাসের ছেলের গোটা শরীর মুড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এর পরের দৃশ্য ভাবলে গা শিউরে ওঠে। বস্তির ঘর থেকে রাস্তা পর্যন্ত দূরত্বই মনে হচ্ছিল যেন, কয়েক হাজার মাইল! যত ক্ষণে রাস্তায় এসে দাঁড়াই, তত ক্ষণে আমাদের গোটা বস্তি দাউদাউ করে জ্বলছে। ছেলেকে শাশুড়ির কোলে দিয়ে টাকার ব্যাগটা বার করে আনার জন্য ঢোকার চেষ্টা করি, কিন্তু পুলিশ যেতে দেয়নি।

সন্ধ্যা সাতটা থেকে এই পর্যন্ত ওই ভাবেই চলছে আমাদের লড়াই। প্রথমে পাড়ার আরও কয়েক জনের সঙ্গেই বস্তির উল্টো দিকের পেট্রল পাম্পে গিয়ে উঠি। অনেকে চাইলেও, ছেলেকে কোলছাড়া করতে চাইনি। এই পরিস্থিতিতে কোন দিকে ছুটতে হয় তো জানি না! সামনে তখন একের পর এক সিলিন্ডার বিস্ফোরণ চলছে। কখনও কখনও আগুন ছিটকে আসছে উল্টোপাড়ের রাস্তা পর্যন্তও। দমকলের গাড়ি ঢুকতেই দেখলাম, আমাদের পাড়া রণক্ষেত্র হয়ে উঠল। ভাঙচুর হল বেশ কয়েকটি গাড়িতে। রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত ওই রাস্তাতেই পড়ে রইলাম ছেলেকে আঁকড়ে ধরে। ঠান্ডায় এবং ধোঁয়ায় ছেলের কান্না থামাতে বস্তাটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে দিলাম ওর গায়ে।

আরও পড়ুন: ‘উদ্বোধন’-এর প্রথম সংখ্যা পোড়ার আশঙ্কা

রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ আমাদের জন্য খুলে দেওয়া হয় বস্তির পাশের বাগবাজার উইমেন্স কলেজ। প্রথমে মাত্র তিনটি ঘর খুলে দেওয়া হয়েছিল। তার কোনওটিতেই তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ভিড়ের মধ্যে ছেলে তখন প্রচণ্ড কাঁদছে। গরম লাগছে বুঝে বস্তাটা খুলে দিয়েছি আগেই। তবুও কান্না থামছে না দেখে, কয়েক জন অন্য কোথাও গিয়ে বসতে বললেন। দেখে মনে হল, তাঁরা বিরক্ত। ফের বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। এ বার ফুটপাতই সম্বল। যে ঠিকানা বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্তও বদলায়নি।

আরও পড়ুন: ‘সব হারিয়েও আমরা এখন ভিআইপি’

স্বামী-স্ত্রী কাজ করে আমরা কয়েক হাজার টাকা জমিয়েছিলাম। কাছেই একটা ঘর ভাড়ায় নেব বলে। বস্তির এই ছোট ঘরে একসঙ্গে সাত জনের হয় না। ছেলেটাও বড় হচ্ছে। আমাদের সব টাকা পুড়ে গিয়েছে। অন্য পাড়া থেকে এসে এ দিন অনেকেই আমাদের গল্প শুনে গিয়েছেন। ঘর ঠিক তৈরি হয়ে যাবে বলে আশ্বাসও দিয়েছেন। অন্য কোথাও উঠে যাওয়ার স্বপ্নও নাকি সফল হবে। আদৌ হবে? গত রাতের ঘটনার জেরে সবই তো ছারখার হয়ে গিয়েছে!

(লেখিকা হাজার বস্তির বাসিন্দা)

অন্য বিষয়গুলি:

Baghbazar Fire Accident Fire Baghbazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy