Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
মুখ্যমন্ত্রী তোলা ও কাটমানির টাকা ফেরত দিতে বলেছেন। নেতাদের ‘রোজগার’ বন্ধ হবে কি?

১০ লক্ষ টাকা খসালেই মিলে যাবে অটো রুটের ‘গেট পাস’

অটো ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যসভার সাংসদ শুভাশিস চক্রবর্তী তোলাবাজি, কাটমানির এই অভিযোগ মেনে নেন।

বিপজ্জনক: পার্ক সার্কাসে নিয়ম ভেঙে উল্টো মুখে যাত্রা অটোর। রাজাবাজার এলাকায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

বিপজ্জনক: পার্ক সার্কাসে নিয়ম ভেঙে উল্টো মুখে যাত্রা অটোর। রাজাবাজার এলাকায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৯ ০২:৪৯
Share: Save:

টেবিল-জোড়া কাচের নীচে ঢাকা অটোর বিভিন্ন রুটের বিরাট তালিকা। কোনও রুটের চাহিদা আকাশছোঁয়া, কোনওটি আবার স্রেফ বাধ্য না হলে কেউ নেন না। টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে গুছিয়ে বসা ব্যক্তিটি বললেন, ‘‘গেট পাস বোঝেন? যে রুটে যত বেশি গেট পাস দিতে হয় তার দাম তত কম। বেশি টাকাও দিয়ে যাতে আর পুলিশের ঝামেলা পোহাতে না হয়, সেটা আমাদেরই দেখে দিতে হয়। পকেট হাল্কা করার দম থাকলে এখানেই সব হয়ে যাবে।’’

মোটর ভেহিকল্‌সে যাতায়াতকারী এক দালালও সেখানে হাজির। সঙ্গে পারমিট পেতে ঘুরতে থাকা এক ব্যক্তি। দালালটির দাবি, ‘‘যে রুটে যত বেশি ট্র্যাফিক গার্ড, সেই রুটের দাম তত কম। কারণ গার্ডপিছু টাকা দিতে হয়। ওটাই গেট পাসের টাকা। তার থেকে ৯-১০ লক্ষ দিয়ে একে বারে ভাল রুট নিলেই বছরভর ঝামেলামুক্ত। বাকিটা ওখানকার এক দাদা দেখে নেবেন।’’

তোলাবাজি, কাটমানি খাওয়া এই ‘দাদা-তন্ত্র’ই বন্ধের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিযোগ জানাতে খুলেছেন গ্রিভান্স সেল। শহরের অটোর দাপটের পিছনেও তোলাবাজির বিরাট চক্র কাজ করে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। টাকা দিয়ে ‘সেট’ করে রাখা শাসক দলের নেতা-দাদাদের জোরেই অটোচালকদের একাংশ রাস্তার যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করানোর সাহস পান বলেই অভিযোগ। পুলিশি নির্দেশ উড়িয়ে অটোয় তারস্বরে তাঁরা বক্স বাজান। নিয়ম উড়িয়ে নিজের পাশে একাধিক যাত্রী বসিয়ে বেপরোয়া ভাবে চলাচল করেন। অভিযোগ, গেট পাসের জোরেই ফ্লাইং অটো নজর ‘এড়িয়ে যায়’ প্রশাসনের।

অটোচালকের বাঁ দিকে দু’জন যাত্রীকে বসিয়ে ঝুঁকির যাত্রা। রাজাবাজার এলাকায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

দিন কয়েক আগেই একটি পথ-দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে একটি অটোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে মানিকতলা থানা। নম্বর ধরে খোঁজ করে দেখা যায়, একই রুটে একই নম্বরের দু’টি অটো চলছে। চক্ষু চড়কগাছ তদন্তকারীর দাবি, ‘‘ধরে থানায় নিয়ে আসার সময়ে চালক বলছে, একটা ফোন করব দাদা বুঝে নেবে। ভুয়ো অটো চালিয়েও সাহস কত!’’ সত্যিই রাজ্যের এক মন্ত্রীর ফোন আসে বলে তদন্তকারী অফিসারটি জানান। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল? উত্তরে স্রেফ হাসি ছাড়া আর কিছুই ছিল না তদন্তকারীর।

শহর এবং শহরতলি মিলিয়ে এখন কলকাতায় প্রায় ৫১০টি নথিভুক্ত অটো রুট রয়েছে। তবে চাইলেই রুটগুলিতে নতুন অটো নামানো যায় না। কারণ, রুট পিছু কত অটো চলছে বা ক’টা অটো থাকতে পারে সেই সংখ্যা তালিকাবদ্ধ করা থাকে। পুরনো অটো চলার অযোগ্য, সেই প্রমাণ ছাড়াও নতুন অটো নামাতেও অটো ধ্বংসের প্রক্রিয়া ভিডিয়োগ্রাফ করে প্রশাসনের কাছে পাঠাতে হয়। ছাড়পত্র মিললে তবেই এগোনো যায়। কিন্তু অটোচালকদের বড় অংশেরই অভিযোগ, এই সবই খাতায়-কলমে সীমাবদ্ধ। স্রেফ ‘দাদার আর্শীবাদ’ থাকলেই আর কিছুর প্রয়োজন নেই। শুধু দাদাকে তুষ্ট রাখতে হয় টাকা দিয়ে।

রানিকুঠি-বাঘা যতীন স্টেশন রুটের এক অটোচালকের বক্তব্য, ‘‘নতুন অটোর দাম খুব বেশি হলে সাড়ে তিন লক্ষ। তার পরেও কেন ৯-১০ লক্ষ টাকা দিতে হয় সেটাই বড় প্রশ্ন।’’ কাদাপাড়া-মেছুয়া রুটের আর এক অটোচালক বলেন, ‘‘পারমিটের জন্য মোটা টাকা দেওয়ার পরেও প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়। খুব বড় মাপের নেতাকে ধরতে গেলে এত জায়গায় চাঁদা দিতে হয় যে, খরচ এমনিই বেড়ে যায়।’’ উল্টোডাঙা-শোভাবাজার রুটের এক চালকের আবার দাবি, ‘‘অনেকের তো পারমিটই নেই। তাঁরাও চলে আসছেন। ওঁরা দাদাদের দেওয়া বিজ্ঞাপন অটোর গায়ে লাগিয়ে ঘোরে। দাদার পকেটও ভরায়। বিভিন্ন সময়ে মিটিং-মিছিলে গিয়েও ভিড় বাড়ায়। ওঁদের কে ধরবে?’’

অটো ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যসভার সাংসদ শুভাশিস চক্রবর্তী তোলাবাজি, কাটমানির এই অভিযোগ মেনে নেন। তিনি বলেন, ‘‘নেতা-কর্মী একে অন্যকে তোলাবাজ বলছেন। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’’

মুখ্যমন্ত্রী বলার আগেই কেন ব্যবস্থা নেননি? অটো সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের কারও মুখেই উত্তর মেলেনি।অতএব, কাটমানি, তোলাবাজি পুষ্ট অটোর রাজ অব্যাহত!

অন্য বিষয়গুলি:

Corruption Bribe Auto INTTUC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy