অযত্নে: গ্যাস ক্রিমেটোরিয়ামের পরিত্যক্ত বাড়ি। নিজস্ব চিত্র
গ্যাসের তাপে শবদাহ হত এ শহরে। তা-ও খ্রিস্টানদের জন্য! ১১৬ বছর আগে কলকাতা পুরসভার তৈরি সেই ‘গ্যাস ক্রিমেটোরিয়াম’ ছিল সম্ভবত এশিয়ায় প্রথম। আজও শহরে টিকে রয়েছে সেটির কাঠামো।
লোয়ার সার্কুলার রোডের সমাধিস্থলের বয়স তখন ৬৩। সাল ১৯০৩। ক্রিমেশন সোসাইটি অব বেঙ্গলের পরামর্শ মেনে ওই সমাধিস্থলের পূর্ব দিকে তৈরি হল সেটি। এ জন্য কলকাতা পুরসভা ৩৪ হাজার টাকা খরচ করেছিল। এর জন্যই সামনের রাস্তার নাম হল ক্রিমেটোরিয়াম স্ট্রিট। পুরসভার হেরিটেজ তালিকায় ‘গ্রেড ওয়ান’ তকমা পাওয়া স্থাপত্যের চারদিকে এখন মাথা তুলেছে ঘনবসতি। ১৯৭৯ সালে শেষ বার সক্রিয় হয়েছিল এটি।
তার অনেক আগেই অবশ্য ইউরোপে শুরু হয়ে গিয়েছিল গ্যাস অথবা উত্তপ্ত বাতাসে শবদেহ পোড়ানোর প্রথা। তথ্য পাওয়া যায়, ক্রিমেশন সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন ১৮৭৮ সালে এবং ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরের পের লাশেজ সমাধিস্থলে শুরু হয় এই প্রথা। ১৮৯৫ সালের ১ ডিসেম্বরের ‘দ্য মর্নিং টাইমস’ লিখছে, ওই বছরের প্রথম চার মাসে পের লাশেজের ক্রিমেটোরিয়ামে ৭৫টি শবের সৎকার হয়েছিল।
গথিক আর্চের সেই জানলা। নিজস্ব চিত্র
অথচ ২, ক্রিমেটোরিয়াম স্ট্রিটে সৎকারের প্রথা সে ভাবে জনপ্রিয় হয়নি বলেই জানা যাচ্ছে। এ দেশে কর্মসূত্রে আসা ইউরোপিয়োরা মারা গেলে, খরচ এবং প্রযুক্তির নিরিখে তাঁদের দেশে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। এই ব্যবস্থা শুরু হওয়ায় তাঁদের সৎকার করে ভস্ম নিয়ে যাওয়া হত। এ ছাড়া বাঙালি খ্রিস্টান, ব্রাহ্ম এবং কিছু ক্ষেত্রে পার্সিরাও এ ভাবে সৎকার করতেন। ক্রিশ্চিয়ান বেরিয়াল বোর্ডের এগ্জিকিউটিভ সদস্য রণজয় বসুর মতে, সেই সময়ে প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরের মতো অসুখে একই খ্রিস্টান পরিবারের একাধিক সদস্য মারা গেলে সমাধিস্থ করার খরচ এবং জায়গা বাঁচাতে এই পদ্ধতি নেওয়া হত। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সৎকার হয়েছিল এখানেই। বেরিয়াল বোর্ডের তথ্য বলছে, সুকুমার রায়ের দিদি সুখলতা রাওয়েরও শেষকৃত্য হয়েছিল এই গ্যাস ক্রিমেটোরিয়ামে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসেছিলেন। এমনটাই জানালেন রণজয় বসু। তাঁর কথায়, “চিকিৎসক আবিরলাল মুখোপাধ্যায় তখন কলকাতার শেরিফ, কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এই গ্যাস ক্রিমেটোরিয়ামে এসেছিলেন তিনি। সেখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা।”
এস ডব্লিউ গুডের ‘মিউনিসিপাল ক্যালকাটা ইটস ইনস্টিটিউশনস ইন দেয়ার অরিজিন অ্যান্ড গ্রোথ’ বইতে রয়েছে এর ইতিহাস। চুল্লিটি ছিল প্যারিসের চুল্লি নির্মাণসংস্থা তোয়াসু ফ্রদে অ্যান্ড কোম্পানির। ১৮টি বুনসেন বার্নার ছিল তাতে। ১৮০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার গ্যাসে চার ঘণ্টা লাগত দেহ পুড়তে। একটি দেহ পোড়াতে ১০০০ কিউবিক ফুট গ্যাস ৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে মোট ৪৫০০ কিউবিক ফুট গ্যাস লাগত। গুডে বইয়ে উল্লেখ করছেন, প্রথম থেকেই কম সৎকার হত এখানে। ১৯১৩-১৪ সালে মাত্র চারটি সৎকার হয়েছিল। ব্যবহার বাড়াতে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন সৎকারের খরচই তুলে দেয়। ১৯১৩-১৪ সাল নাগাদ এর রক্ষণাবেক্ষণে বছরে ৭৭২ টাকা খরচ হত। পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আসত। পরে দুর্গাপুর থেকে সরাসরি আসত গ্যাস। দৈনন্দিন জীবনে গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়। সৎকার চলাকালীন আটকে যাচ্ছিল গ্যাস সরবরাহ। তাই বন্ধ করে দেওয়া হয় এটি।
লাল ইট ও টালির নকশা-সহ গথিক আর্চের স্থাপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে ভবনটি। দূর থেকে মনে হবে, তারই গায়ে গথিক আর্চের জানলা-সহ মিনার। আসলে ওটাই ছিল চিমনি। ভাঙা জানলা আর পুরনো শরীরে জড়িয়ে শিকড়। ভিতরে চিরবিশ্রামে তোয়াসু ফ্রদে অ্যান্ড কোম্পানির চুল্লির অবয়ব। দাহ-পুরাণের এই বিবর্ণ অতীত বইছে শহর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy