Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Sex Worker

প্রান্তবাসী মেয়েদের পাশে সংগ্রামী দেবদাসী মা

নারীর অধিকার আন্দোলন নিয়ে বহু আস্ফালনের তুলনায় প্রচারহীন, তেজি এই মা-মেয়ের লড়াই!

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:৪৫
Share: Save:

পাশাপাশি বসে মা-মেয়ে। জড়তাহীন, ঋজু, সাবলীল। মা কর্নাটকের সৌনদত্তি প্রদেশের প্রখ্যাত ইয়েল্লাম্মা দেবী মন্দিরের দেবদাসী। তাঁর মেয়ে বাণিজ্য শাখায় স্নাতক হওয়ার পরে মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের শিবাজী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজসেবা বিদ্যায় স্নাতকোত্তর (মাস্টার ইন সোশ্যাল ওয়ার্ক)। পঁয়ষট্টিতে পা দিয়েও দেবদাসী প্রথার বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করছেন মা। পেশার কারণে ভোগ করা সামাজিক বৈষম্য ও পারিবারিক বঞ্চনার বিপক্ষে লড়ছেন। সেই লড়াইয়ে পাশে রয়েছে তাঁর বছর পঁচিশের মেয়ে। যাঁর বড় হওয়ার পর্বের অনেকটাই কেটেছে মায়ের থেকে দূরে ইংরেজি বোর্ডিং স্কুলে। কিন্তু সেই দূরত্বে মাতৃপরিচয় নিয়ে কোনও কুণ্ঠা আসেনি তাঁর। বরং মায়ের সংগ্রামে শ্রদ্ধা বেড়েছে।

মেয়েকে পাশে বসিয়েই মা সংবাদমাধ্যমকে জানালেন, শোলাপুরকে স্মার্টসিটি করতে সেখানকার যৌনপল্লি বন্ধ করে মেয়েদের উৎখাত করার পরিকল্পনা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করানো হয়। বিচারে কারও শাস্তি না হলেও তাঁকে দমানো যায়নি। মেয়ে সগর্বে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে বলেন, ‘‘মা যে ভাবে ঝড় সামলে যুদ্ধ চালাচ্ছেন তা অবিশ্বাস্য। অন্ধকার দুনিয়ার মেয়েদের আধিকার ও আইনি সাহায্য পাইয়ে দেওয়ার যে কাজ করছি তার অনুপ্রেরণা মা।’’

নারীর অধিকার আন্দোলন নিয়ে বহু আস্ফালনের তুলনায় প্রচারহীন, তেজি এই মা-মেয়ের লড়াই! যৌনকর্মীদের জন্যে কাজ করা কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সম্প্রতি আয়োজন করেছিল তাঁদের অধিকার সংক্রান্ত সম্মেলনের। তাতে যোগ দিতে এসেছিলেন দেবদাসী রাধাবাঈ (নাম পরিবর্তিত) আর তাঁর বড় মেয়ে বিনিতা (নাম পরিবর্তিত)।

কর্নাটকের বীজাপুর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ববলেশ্বর নামে ছোট্ট গ্রামে জন্মেছিলেন রাধাবাঈ। দিদা ও মা ছিলেন দেবদাসী। গ্রামে রোজগার কমে যাওয়ায় তিন মাসের রাধাবাঈকে নিয়ে তাঁর মা ও দিদা চলে যান শোলাপুরের যৌনপল্লিতে। স্থানীয় এক মাস্টারমশাইয়ের চেষ্টায় স্কুলে ভর্তি করানো হয় রাধাবাঈকে। বরাবরের মেধাবী ছাত্রী দেবদাসী হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশও করেছিলেন।

রাধাবাঈ বলছিলেন, ‘‘যখন সেভেনে উঠি বদলে গিয়েছিল পাড়া চেনা চোখগুলো। সাইকেলে চড়ে যাওয়ার সময়ে ওরা নোংরা ইশারা করে বলত, ‘কাশ্মীনের মেয়ে স্কুলে গিয়ে কী করবি? আমাদের কাছে আয়।’ আমাদের ভাষায় ‘কাশ্মীন’ মানে ধান্দেওয়ালি। অপমানে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরতাম। দিদা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল আমাকে দেবদাসী হওয়া থেকে বাঁচাতে। যাতে কেউ আমাকে কিছু বলতে না-পারে তাই আমার সাইকেলের পিছনে বসে স্কুল পর্যন্ত যেত এর পর থেকে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।’’ ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে সেই দিদাই তাঁকে নিয়ে গেলেন বেলগাঁওয়ের সিদ্ধাচল পাহাড়ের উপর ইয়েল্লাম্মার মন্দিরে। দেবদাসী প্রথার জন্য প্রসিদ্ধ সেই মন্দির। এর পরেও অবশ্য পড়াশোনা চালিয়েছিলেন তিনি।

তাঁর দিদিমা ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু রাধাবাঈ হননি। নিজের তিন মেয়েকে দেবদাসী বা যৌনকর্মী হতে দেননি তিনি। পরম্পরা ভেঙে এখন তিন জনেই চাকুরিরতা।

রাধাবাঈ নিজে দেবদাসী এবং যৌনকর্মীদের অধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। দেবদাসীদের পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয় না। কিন্তু মেয়েদের অধিকার বুঝে নিতে অকুতোভয় রাধাবাঈ খুড়তুতো ভাইদের হুমকির পরোয়া না করে গ্রামে ফিরে মা-দিদার কেনা জমিতে দাঁড়িয়ে থেকে চাষ করাচ্ছেন। তাঁর এই সংগ্রাম কাহিনি এ শহরের প্রান্তবাসী মেয়েদের আর্থ-সামাজিক-শারীরিক ভাবে পিষে ফেলার ফন্দির বিরুদ্ধে শক্তি জোগাবে বলে বিশ্বাস করছেন তাঁর মতো যুদ্ধ শুরু করা অনেকেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Sex Worker Human Rights
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy