২২ নভেম্বর ২০২৪
manoj mitra

‘মনোজাগতিক’ সন্ধ্যায় নাটকের স্মৃতিকথারা

নিজের লেখা নাটকের নেপথ্য কাহিনী নিয়ে আলোচনায় মনোজ মিত্র

আলোচনায় মেঘনাদ ভট্টাচার্য এবং মনোজ মিত্র

আলোচনায় মেঘনাদ ভট্টাচার্য এবং মনোজ মিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২১ ২১:৪১
Share: Save:

সময় চলিয়া যায়, তবু কথা ফুরায় না। পূর্ব বাংলার এক গ্রাম থেকে পথ চলা শুরু করে কলকতায় আসা। দক্ষতায়, প্রতিভায়, অভিনয়ে আপামোর বাঙালির মন জয়। যে মানুষটা তাঁর নিজের হাতে বাংলা থিয়েটারের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন, তিনি মনোজ মিত্র।

তিরাশি বসন্ত পার করেও বাঞ্ছারাম এখনও সযত্নে আগলে রেখেছেন নিজের বাগান। প্রায় একশোরও বেশি নাটক লিখে, মঞ্চে ও চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের পরেও বলতে পারেন, "আমি আজও অভিনয় করে যাই। আমার অভিনয় মানুষের মনের কথা বলে।"

২৩ নভেম্বর, মঙ্গলবার, নাট্যকার তথা লেখক মনোজ মিত্রকে নিয়ে শহর কলকাতার একটি লাউঞ্জে সান্ধ্য অনুষ্ঠান - ‘আখর’-এর আয়োজন করেছিল শ্রী সিমেন্ট এবং প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা মেঘনাদ ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন সীমা মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো নাট্যজগতের মহীরুহরা। আলাপে, গল্পে, নিজের লেখা নাটকগুলির নেপথ্যে থাকা বিভিন্ন কাহিনী তুলে ধরলেন মনোজ মিত্র।

তাঁর বক্তব্যের প্রথমেই উঠে এল অদ্ভুত এক গ্রামের কথা। যেখানে পিসিমার সঙ্গে তিনি থাকতেন। সেখানে নাকি ম্যলারিয়া ছিল গৃহপালিত ব্যাধি। গল্প শোনালেন চোর আর গৃহস্থের এক অদ্ভুত সহাবস্থানের। এক রাতে তাঁদের ঘরে চোর ঢোকে। পিসিমার হাঁকে সেই চোর ভেগেও যায়। পিসিমা শুধু বলেছিলেন, ‘বাসন নিয়ে আমাদের সমস্যা বাড়াসনি, বরং কাল এসে খেয়ে যাস।’ পরদিন পুকুরে স্নান করে হাজির সেই চোর - বাখের আলি। দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ সবার। পরে তাঁকে খাইয়ে, ধান-চাল দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়।

এমন অনেক মজার মজার গল্পই শোনাচ্ছিলেন মনোজ মিত্র। তাঁদের গ্রামে ছিল থিয়েটারের চল। যাত্রা নয়, একদম শহরের থিয়েটার। যে গ্রাম থেকেই হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর নাট্য ব্যক্তিত্বের। সেই গ্রামেই একবার শরৎচন্দ্রের লেখা ‘রামের সুমতি’ চলছে। মেয়েদের ভূমিকায় ছেলেরাই অভিনয় করছেন। সারা ক্ষণ তাঁরা কাপড় টানতে ব্যস্ত। কিন্তু নাটক কিছুতেই জমছে না। মঞ্চে মাছ নিয়ে প্রবেশের দৃশ্যে হঠাৎই, দু’টো জ্যান্ত মাছ ঝুড়ি থেকে স্টেজে লাফিয়ে পড়ল! সারা স্টেজ সেই মাছগুলো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই দেখতে গিয়ে দর্শকরাও যেন চনমনে হয়ে উঠল। মনোজ মিত্রের ভাষায় — যেন, এত ক্ষণে দু’টো জ্যান্ত জীব মঞ্চে উঠেছে!

সেই মাছের গল্পের রেশ ধরেই অন্য এক গল্পে টেনে নিয়ে গেলেন তিনি। তখন শীতকাল। বিজয়া সম্মেলনীতে ঠিক হল রবীন্দ্রনাথের ‘রোগের চিকিৎসা’ মঞ্চস্থ হবে। হারাধনের চরিত্রে প্রথমবার মঞ্চে পা রাখলেন অভিনেতা মনোজ। ঠিক ছিল, তুলোর হাঁস তৈরি করা হবে এবং নাটকের দৃশ্যে পেটে খোঁচা মারলে ডিরেক্টর হাঁসের আওয়াজ করবেন। হঠাৎই সেই ছোট বেলায় জ্যান্ত মাছের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। ইচ্ছে হল, হাঁসও যদি জ্যান্ত রাখা হয় তা হলে লোকের উৎসাহ বেড়ে যাবে। বিকেল থেকে একটা জ্যান্ত হাঁস পেটের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কেউ জানত না। ডিরেক্টরও না। সেই দৃশ্যে পেটে খোঁচা পড়তেই জ্যান্ত হাঁস ডেকে উঠল! ডিরেক্টরও ডেকেছেন। লোকজন হইচই শুরু করল। যেই জ্যান্ত হাঁস পেট থেকে বেরল, থিয়েটার গেল জমে। অথচ হাঁসের নখের আঁচড়ে মনোজ মিত্রের পেট থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।

আজকের দিনে দাঁড়িয়েও মনোজ মিত্র মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে দর্শকরা চান মঞ্চের উপরে বাস্তবটা দেখতে। সত্যিটা দেখতে। তাঁর কথা অনুযায়ী, “লোকে বলেছিল নাটকটা আমার জন্য খুলেছিল, তা নয়। আসলে সেটা হাঁসটার জন্যই সম্ভব হয়েছিল।”

এত বড় নাট্যব্যক্তিত্ব, অথচ বাবা কিন্তু কখই চাইতেন না যে মনোজ থিয়েটার করুক। তবে গতে বাঁধা পড়াশুনাকে কখনই আমল দেননি তিনি। নাটক তাঁকে বার বার টেনে নিয়ে গিয়েছে। সেই কথাও উঠে এল তাঁর কথায়।

বহু নাটক, বহু স্মৃতি। ভাঙা গলায় তার খানিকটাই তুলে ধরলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে প্রথম দল গঠন করেন। ‘তক্ষক’, ‘অশ্বত্থামা’-র মতো নাটক খুব কম সময়েই জনপ্রিয়তার দোরগোড়ায় পৌঁছায়। কিন্তু ৭০-এ ভেঙে যায় সেই দল।

কিন্তু থামেনি মনোজ মিত্রের অশ্বমেধের ঘোড়া। কলকাতার বেলগাছিয়ার বাড়িতে আসা ফণী বাবু থেকে ম্যাজিশিয়ানের সেই কালো কোট, জাদু-কাঠি। তাঁর জীবনে ঘটা সমস্ত মজার, দুঃখের গল্পকেই নাটকে বেঁধে ফেলতে পেরেছিলেন মনোজ মিত্র। ‘চাকভাঙা মধু’, ‘পরবাস’, ‘সাজানো বাগান’ আরও কত কী! প্রত্যেকটি গল্পে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বাস্তবের পটচিত্র।

অমলিন গলা। বাঞ্ছারামের সেই বাগানের গল্প। সমস্ত কিছুকে স্মৃতির চাদরের উষ্ণ আদরে সযত্নে লালন করে রাখবেন আপামোর বাঙালি। মনোজ মিত্র একজনই হতে পারবেন। তাঁর পথচলা প্রেরণা যোগাবে শত শত নাট্যানুরাগীকে। আর তিনি দর্শক, শ্রোতাদের মধ্যমণি হয়ে কোনও এক মঞ্চে মাইক হাতে স্মৃতির সঙ্গে বাস্তবকে একাকার করে দিয়ে ফের বলবে, ‘স্মৃতি বয়ে যায়, স্মৃতি মুছে যায় না।’

অন্য বিষয়গুলি:

manoj mitra theatre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy