শিল্পী: ছবির রঙে মগ্ন দেরবাজ। নিজস্ব চিত্র
মাঠ ভরা সোনালি ফসল। আঁটি বেঁধে ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখেন কৃষক। ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সত্যি হয় অন্য কারও তুলির টানে। এক হাতের সেই শিল্পীরও স্বপ্ন ছিল। একটা সময়ে ক্রিকেট-ফুটবল খেলে মেতে থাকত তাঁর কিশোরবেলা। সেই সময়েই এক দিন বাঁ হাতের তালুতে সলিড টিউমার ধরা পড়ে। জানা যায়, ১২ বছরের ওই কিশোর ক্যানসারে আক্রান্ত। বাদ দিতে হয় হাত। স্বপ্নভঙ্গের সেই শুরু। যত বারই ঘুরে দাঁড়াতে চান, আর্থিক প্রতিবন্ধকতা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে ধরে কৈশোর পেরোনো যুবক দেবরাজ চট্টোপাধ্যায়কে। আপাতত একটি প্রস্থেটিক হাতের অভাবে থমকে তাঁর স্বপ্নপূরণের যাবতীয় প্রচেষ্টা।
বাবা দেবদাস চট্টোপাধ্যায় স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিত। মা ইলা চট্টোপাধ্যায় গৃহবধূ। একমাত্র সন্তান দেবরাজের যখন ১২ বছর বয়স, তখন সে টের পায়, ক্রিকেট ব্যাট ধরতে বাঁ হাতের তালুতে ব্যথা লাগছে। স্থানীয় চিকিৎসককে দেখিয়ে এক্স-রে করে সিস্ট ধরা পড়ে। বারাসতের সরকারি হাসপাতাল ঘুরে পিসতুতো দিদির সাহায্যে বালিগঞ্জের একটি নার্সিংহোমে গিয়ে ধরা পড়ে, সেই সলিড টিউমারটি ক্যানসারে আক্রান্ত। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয় দেবরাজের। বায়প্সির রিপোর্ট দেখে ও মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্তে বাঁ হাত কনুইয়ের নীচ থেকে বাদ দিতে হয়। পাশাপাশি, চলে ছ’টি কেমোথেরাপি। সেই সময়ে পরিবার, পরিচিত এবং চিকিৎসকেরা পাশে দাঁড়িয়ে জুগিয়েছিলেন চিকিৎসার খরচ।
২০১৮ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড আর্ট বিভাগ থেকে স্নাতক হন দেবরাজ। স্বপ্ন ছিল স্নাতকোত্তর করার। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক অনটন এবং একটি হাত। শিল্পী হতে চাওয়া সেই যুবক এখন উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার বেড়াচাঁপায় বাড়ির কাছেই ছোট সাইবার কাফে খুলেছেন। শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই লকডাউনের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেটি। এখন আবার চালু হলেও সেই কাফে চলছে কোনও রকমে। ২৭ বছরের দেবরাজের আয়ের মূল সংস্থান ছোটদের আঁকা শিখিয়ে মাসে হাজার দশেক টাকা।
হাত বাদ যাওয়ার পরে শুরুর দিকে বার বার ব্যর্থ হয়েও আঁকা এবং ছবি তোলার নেশায় নিজেকে মেলে ধরেছিলেন দেবরাজ। স্নাতকের ছাত্র থাকাকালীন ট্রেসিং, কম্পিউটারের কাজ করতে সমস্যা হত। বন্ধুহীন, অন্তর্মুখী দেবরাজের কথায়, ‘‘স্নাতকোত্তরে ভিডিয়ো এডিটিং বা ফোটোগ্রাফি নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু বুঝেছিলাম যে, এক হাত দিয়ে কাজ করতে সমস্যা হবে। তা ছাড়া, জিনিসপত্রের দামের কারণেও আমার পক্ষে পড়া চালানো কষ্টসাধ্য হত।’’
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় ২০১৭ সালে নিখরচায় প্রস্থেটিক হাত পান ওই যুবক। কিন্তু তা দিয়ে হালকা কিছু ধরা বা ঠেকনা দেওয়ার কাজটুকু শুধু করতে পারতেন বলে জানাচ্ছেন তিনি। বনগাঁ লোকালের ভিড়ে যাতায়াত করতে গিয়ে প্রথম বছরেই সেই হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিনামূল্যে তখনকার মতো সারাই করা হলেও এখন প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে হাতটি। প্রস্তুতকারী সংস্থা দেবরাজকে জানিয়েছে, হাতটির যন্ত্রে সমস্যা হলে মেরামতিতে খরচ পড়বে দেড়-দু’লক্ষ টাকা। যা দেবরাজের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। ফলে, হাতের অভাবে অনেক ইচ্ছের সঙ্গেই বন্ধ রয়েছে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তাঁর গান গাওয়াও।
ঠাকুরপুকুরের ওই হাসপাতালের শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসক সোমা দে চিকিৎসা করেছিলেন কিশোর দেবরাজেরও। সোমা বলেন, ‘‘দেবরাজের হাতে যেটা হয়েছিল, সেটির নাম ম্যালিগন্যান্ট পেরিফেরাল নার্ভ শিথ টিউমার। অস্ত্রোপচারে ক্যানসার আক্রান্ত কোষকে সম্পূর্ণ বাদ দিতে পারলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ক্যানসার যাতে আর না ফিরে আসে, তাই ওঁর মিড আর্ম থেকে বাঁ হাত বাদ দিতে হয়েছিল। দেবরাজ এক জন শিল্পী। ওঁর জন্য ফাংশনাল হাত প্রয়োজন। ওঁর সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সকলের এগিয়ে আসা উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy