স্যালাইন ধরে আম্বিয়া মণ্ডলকে নিয়ে যাচ্ছেন পরিজনেরাই । ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
‘‘আমাদের হাতে কিছু গুঁজে না দিলে কোনও ডাক্তারের কাছেই পৌঁছনো যাবে না। ঘুরেই বেড়াতে হবে!’’ হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ানো রোগীর আত্মীয়দের ভিড়ের কাছে গিয়ে নিচু গলায় কথাটা বললেন এক ব্যক্তি। কত দিতে হবে? প্রশ্ন শুনে ওই ব্যক্তি এ বার বললেন, ‘‘রোগ বুঝে টাকা। এখন অন্তত ২০০ মতো দিন।’’
এ ভাবে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়েই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রোগীর আত্মীয়দের। এক দুপুরে ওই হাসপাতালে বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা গেল, এমনই চক্রের রমরমা চলছে। টাকা দিতে পারলে ওই ব্যক্তিই রোগীর পরিবারকে বহির্বিভাগের পথ দেখিয়ে দেন। কোন সিঁড়ি দিয়ে গেলে ভিড় কম হবে, তা-ও বলে দিচ্ছেন তাঁরাই। বাড়তি কিছু টাকা খসাতে পারলে তাঁদের থেকেই জানা যাচ্ছে বহির্বিভাগে উপস্থিত চিকিৎসকের নাম। আরও বেশি টাকা দিতে পারলে হাতে চলে আসবে চিকিৎসকের ফোন নম্বরও!
যেমন, বছর পঞ্চাশের আম্বিয়া মণ্ডলকে নিয়ে ওই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন তাঁর বাড়ির লোকজন। পেট ফাঁপার সমস্যা নিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে আসা ওই রোগীকে প্রথমে ন্যাশনাল মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে বহির্বিভাগে দেখাতে বলা হয়। কিন্তু কোনটি বহির্বিভাগ, কিছুতেই তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁর পরিবারের লোকজন। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এক হাতে স্যালাইনের বোতল ধরে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন তাঁর আত্মীয়েরা।
ওই রোগীর আত্মীয় আনোয়ার হোসেন মণ্ডল বললেন, ‘‘জরুরি বিভাগ থেকে এসে বহির্বিভাগে ঢুকলাম। সেখান থেকে বলা হল, জরুরি বিভাগে দেখাতে হবে। ফের জরুরি বিভাগে গেলে সেখান থেকে আবার বহির্বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এর পরে ওই বহির্বিভাগ থেকে বলে দেওয়া হল, স্ত্রীরোগ বিভাগে গিয়ে দেখাতে হবে। সেখান থেকেও ফের আগের বহির্বিভাগেই পাঠানো হল। সেখানেই এক ব্যক্তি বললেন, ২০০ টাকা না দিলে কোনও ডাক্তারই নাকি দেখবেন না! টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাতে হল।’’ তাঁর আর এক আত্মীয় বললেন, ‘‘তত ক্ষণে দাঁড় করিয়ে রাখা অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া হয়ে গিয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা। দীর্ঘ অপেক্ষা করিয়ে রেখে বিকেল তিনটে নাগাদ চিকিৎসক বললেন, নেওয়া যাবে না। শয্যা নেই। টাকা দিয়ে তা হলে লাভ কী হল? শেষে অ্যাম্বুল্যান্সে বাড়ি ফিরে এসে দিতে হল সাড়ে ন’হাজার টাকা।’’
হৃদ্রোগে আক্রান্ত আলিমুন বিবি নামে এক রোগীকেও একই ভাবে হন্যে হয়ে ঘুরে নাকাল হতে হয়েছে বলে অভিযোগ। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা আলিমুনের ছেলে মনিরুল শেখ জানান, শৌচাগারে হঠাৎ পড়ে গিয়েছিলেন আলিমুন। দ্রুত তাঁকে বেথুয়াডহরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগী হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে তাঁকে কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালে রেফার করে দেয় ওই হাসপাতাল। সেখানে এক রাত রাখার পরের দিনই তাঁকে কল্যাণী হাসপাতালে রেফার করা হয়। ওই হাসপাতালও রোগীকে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (এনআরএস) রেফার করে দেয়। এন আর এস ভর্তি নিলেও পরদিন রোগীকে বাঁচানো সম্ভব নয় জানিয়ে ছুটি দিয়ে দেয়। তারও পরের দিন ন্যাশনাল মেডিক্যালে এসে ওই রোগীকে নিয়েই ছুটে বেড়াতে হয়েছে তাঁর পরিজনদের। মনিরুল বললেন, ‘‘এতগুলো হাসপাতাল ঘুরে অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া হয়েছে ১৬ হাজার টাকা। এখানেও এক ভবন থেকে আর এক ভবনে ঘোরার পরে এক পরিচিত দাদা ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। করোনা পরীক্ষা করানো হয়েছে, এর পরে জানি না কী হবে!’’ মনিরুলেরও অভিযোগ, ‘‘বহির্বিভাগে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের থেকেও টাকা চাইছিলেন এক ব্যক্তি। পরিচিত লোক আছে বলায় আর কিছু বলেননি।’’
এই অভিযোগ এবং শয্যার আকাল প্রসঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ অজয়কুমার রায়কে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। উত্তর মেলেনি ওই হাসপাতালের সুপার সন্দীপ ঘোষের কাছ থেকেও। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy