Advertisement
০৩ জানুয়ারি ২০২৫
Police

বিস্ফোরণের তদন্তে এসে পুলিশ ছুটল পুকুরে মাছ ধরতে

অবৈধ বাজি কারখানায় সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশে ঘরে ঘরে যেন বিপদের কুটির শিল্প।

A Photograph of policemen catching fish in a pond

পুটখালি-মণ্ডলপাড়ায় বাজি তৈরি হওয়ার সময়ে বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া বাড়ির পাশের পুকুরে বৃষ্টিতে মাছ ধরার তোড়জোড় তদন্তে আসা পুলিশকর্মীদের।  ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৩ ০৫:২৮
Share: Save:

বিস্ফোরণের পরে ১৬-১৭ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। তবু, বাতাস ভারী বারুদের গন্ধে। সেই ভারী ভাব আরও বেড়েছে আকাশ মেঘলা থাকায়। মাঝেমধ্যেই মেঘ ডাকছে। একটু পরেই শুরু হল ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মহেশতলা থানা এলাকার পুটখালি-মণ্ডলপাড়ায় বাজি কারখানার বিস্ফোরণস্থলে তত ক্ষণে এসেছে পুলিশের তদন্তকারী দল। নিজে ভিজলেও ‘বড় বাবুর’ মাথায় ছাতা ধরে হাঁটছেন নিচুতলার এক পুলিশকর্মী। পিছনে আরও অনেকে।

তবে, বিস্ফোরণস্থল নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখা গেল না তদন্তকারীদের। যে বাড়িটির চাল খড়কুটোর মতোউড়ে গিয়েছে, তার পাশেই বিশাল পুকুর। ছাতা মাথায় ‘বড় বাবু’ গিয়ে দাঁড়ালেন পুকুরের সামনে। আবহাওয়ার প্রশংসা করে ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন মাছ ধরার! পুকুরপাড়ে ‘বড় বাবু’ বসবেন বলে ছাউনির ব্যবস্থা করতে ত্রিপল খুলে নিয়ে আসা হল স্থানীয় একটি মন্দিরের গা থেকে। খোঁজ শুরু হল বড়শির। অত্যুৎসাহী কয়েক জন ছুটলেন বড়শি আনতে। বিস্ফোরণে মৃত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বাড়িতেও খোঁজা হল বড়শি। কিন্তু, বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও বড়শি না পেয়ে শেষমেশ ইচ্ছা প্রত্যাহার করলেন ‘বড় বাবু’!

কিন্তু, বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে যেখানে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে এসে মাছ ধরার তোড়জোড়! তদন্ত নিয়ে গা-ছাড়া মনোভাবের প্রশ্ন তো পরে, মানবিকতার দিক থেকেও কি ব্যাপারটা আদৌ শোভন? প্রশ্নটা করা হয়েছিল কাজের সূত্রে ওই এলাকার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত এক জনকে। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘‘এখানে এটাই বাস্তব। প্রতি বছর এখানে ১০-১৫ জনের মৃত্যু হয় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে। কিন্তু, তার পরেও কারও মধ্যে হেলদোল দেখা যায় না। পুলিশ-প্রশাসন মৃতের সংখ্যা গোপন করতে ব্যস্ত থাকে। যাঁর কারখানায় বা বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে, তিনি জানেন, কেউ ক্ষতিপূরণ চাইতে আসবেন না। পুলিশও তল্লাশি করবে না। গ্রেফতার করলে বড়জোর জেল হেফাজত হবে এবং কয়েক মাস পরেই জামিন পেয়ে যাবেন!’’ এতই সহজ? উত্তর এল, ‘‘এই বিস্ফোরণের পরেও দেখুন, পুলিশ কিছুই বাজেয়াপ্ত করেনি। তার মানে, এত বড় বিস্ফোরণের পরেও বাজেয়াপ্ত করার মতো বারুদ বা অন্য কিছু মেলেনি! আদালতেও ধৃতের জেল হেফাজত চাওয়া হয়েছে। আসলে পুলিশ তো জানে, যে বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখানেই বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামাল ছিল। ফলে, আর কিছু খুঁজে দেখার প্রয়োজনই নেই।’’

মহেশতলা থানা ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার অন্তর্গত। সেখানকার সুপার রাহুল গোস্বামী বলেন, ‘‘মানবিক দিক থেকে তো বটেই, এমনটা কোনও ভাবেই হওয়ার কথা নয়। কী হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’

স্থানীয়দের একাংশের দাবি, পুলিশ-প্রশাসনের এমন উদাসীন ভূমিকা নতুন নয়। তাই একের পর এক মৃত্যুর পরেও চম্পাহাটি, মহেশতলার ‘বাজি-গড়’-এর চিত্র বদলায় না। মাসে মাসে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে নেতা-দাদাদের মাধ্যমে বাজি ব্যবসার লাভের গুড়ের কিছুটা উঁচু মহলে পৌঁছে যায় বলে অভিযোগ। আছে থানা স্তরের মাসকাবারি হিসাবের গল্পও। এ-ও শোনা যায়, বছরভর চোখ বুজে থাকার ‘পারিশ্রমিক’ হিসাবে উৎসবের মরসুমে পুলিশ-প্রশাসনেরকর্তাদের হাতে মোটা টাকার বাজি তুলে দিতে হয় বাজি ব্যবসায়ীদের। এক স্থানীয় বাসিন্দার মন্তব্য, ‘‘যে হেতু প্রচুর টাকা লাভ থাকে, তাই গায়ে লাগে না। এমনও লোক এখানে আছেন, যিনি পুলিশের চাকরি ছেড়ে বাজি ব্যবসায় নেমেছেন। তা হলেই ভাবুন, কত লাভ।’’

‘বাজি শিল্প উন্নয়ন সমিতি’ সূত্রের খবর, এমনিতে ১৫ কেজি পর্যন্ত বাজি এবং বাজির মশলা তৈরির ক্ষেত্রে লাইসেন্স নিতে হয় জেলাশাসকের কাছ থেকে। ১৫ থেকে ৫০০ কেজি হলে ‘কন্ট্রোলার অব এক্সপ্লোসিভস’-এর কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়াই নিয়ম। তারও বেশি ওজনের বাজির ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্স দেন ‘চিফ কন্ট্রোলার’। এর পাশাপাশি, প্রতিটি কারখানা ১৫ মিটার দূরে হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে বাজির মশলা তৈরি, বাজি তৈরি এবং বাজি প্যাকেটবন্দি করার কাজও আলাদা ভাবে করতে হয়। ‘সারা বাংলা আতশবাজি উন্নয়ন সমিতি’র চেয়ারম্যান বাবলা রায় বললেন, ‘‘চম্পাহাটি, নুঙ্গিতে এর কোনওটাই মানা হয় না। পুলিশ নিজের হিসাব বুঝে নিয়ে চুপ থাকে।’’ তাঁর অভিযোগ, রাজ্যের বাইরে থেকে বাজি তৈরির কাঁচামাল এলেও কেউ ধরে না। কাদের হাত ঘুরে সেই কাঁচামাল কোথায় যায়, কেউ দেখে না। মহেশতলার বাজি মহল্লার বাজি কারবারি তথা ‘প্রদেশ আতশবাজি ব্যবসায়ী সমিতি’র সম্পাদক সুখদেব নস্কর যদিও বললেন, ‘‘বহু ব্যবসাতেই তো ভুল হয়। ভুল শুধরে নেওয়া যায় কী ভাবে, তা নিয়ে আলোচনা করতেই আগামী শুক্রবার পরিবেশ ভবনে আমাদের ডাকা হয়েছে। মন্ত্রীরা কী পথ দেখান, দেখা যাক।’’

তার পরে কি বিপজ্জনক ব্যবসায় বদল আসবে? অতীতের অভিজ্ঞতা কিন্তু আশা দেখানোর মতো নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

police Explosion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy