জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এবং অনশনের নানা মুহূর্ত। —ফাইল চিত্র।
আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল স্বাস্থ্য ভবন অভিযান দিয়ে। তারিখটা ২১ অগস্ট, দিনটা ছিল শনিবার। পরের স্বাস্থ্য ভবন অভিযান ছিল ১০ সেপ্টেম্বর। সেখান থেকেই জুনিয়র ডাক্তারেরা পোস্টার তুলে ধরে জানিয়ে দেন, ‘উৎসবে ফিরছি না’। তার পর একাধিক বার সরকারের তরফে আলোচনার প্রস্তাব এসেছে। আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু জটিলতা কাটেনি। বরং ক্রমশ জোরালো হয়েছে রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন। গত ১৫ অক্টোবর রাজ্যের উদ্যোগে পুজোর কার্নিভাল চলছিল রেড রোডে। তার অনতিদূরে তখন অনশনে বসেন কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তার। সোমবার ১৭ দিনের সেই ‘আমরণ অনশন’ তুলে নেওয়া হল। কিন্তু ৭০ দিন পেরিয়ে যাওয়া আরজি কর আন্দোলন এখানেই থামছে না। সোমবার রাতে ধর্মতলার অনশনমঞ্চ থেকে সে কথাই জানিয়ে রাখলেন আন্দোলনকারীরা।
২ মাস ১০ দিনের আন্দোলনে এসেছে নানা বাঁক। কখনও কখনও জট কাটার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুত, সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দলের প্রায় ২ ঘণ্টার বৈঠকের পর অনশন উঠলেও আন্দোলন জিইয়ে থাকল। আলোচনা শেষে জুনিয়র ডাক্তারেরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া’র অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ করেছেন তাঁদের শিক্ষকদের অসম্মানেরও। আর নির্যাতিতার জন্য বিচার ছিনিয়ে না-আনা পর্যন্ত আন্দোলন শেষ করার কথা তাঁরা মনে আনতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন দেবাশিস হালদার, রুমেলিকা কুমারের মতো জুনিয়র ডাক্তারেরা।
গত ৯ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে চারতলার সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় এক তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার দেহ। অভিযোগ ওঠে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে তাঁকে। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। আলোড়নের সেই শুরু। ওই ঘটনার দু’দিন পর ১১ অগস্ট অপসারিত হন আরজি করের সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠ। তার ঠিক পরের দিন পদত্যাগ করেন আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। দু’জনের ভূমিকা নিয়েই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মামলা গড়ায় কলকাতা হাই কোর্টে।
১৩ অগস্ট কলকাতা হাই কোর্ট পুলিশের হাত থেকে তদন্তভার দেয় সিবিআইর হাতে। আর ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচির মধ্যে ঘটে যায় অনভিপ্রেত একটি ঘটনা। একদল লোক আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে ভাঙচুর চালান। হাসপাতাল চত্বরে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ মঞ্চও ছাড় পায়নি। তার মধ্যে আরজি করে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত খতিয়ে দেখতে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের নির্দেশ দেয় নবান্ন। কিন্তু আরজি কর ইস্যু থেমে থাকেনি। বরং জল গড়ায় শীর্ষ আদালত পর্যন্ত। গত ১৮ অগস্ট সুপ্রিম কোর্ট আরজি কর-কাণ্ডে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করে। আর তার তিন দিন পর স্বাস্থ্য ভবন অভিযান করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
ঘটনাক্রমে আরজি কর-কাণ্ডে টালা থানার ওসি গ্রেফতার হন সিবিআইয়ের হাতে। আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে সন্দীপ, সঞ্জয়-সহ বেশ কয়েক জনের বাড়িতে অভিযান চালান কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। সে সবের মধ্যেই চিকিৎসকদের আন্দোলনের ঝাঁজ আরও বেড়েছে। যে আন্দোলনের রেশ পৌঁছে যায় কলকাতা পুলিশের সদর দফতর পর্যন্ত— জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযান দিয়ে।
২ সেপ্টেম্বর রাতভর লালবাজারের সামনের রাস্তায় ছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সমর্থনে এগিয়ে আসেন সিনিয়রেরা। আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা পাশে পান বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টদের। তার পরের দিন জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে রাতে ‘আলো নেভানো’ কর্মসূচিতে সাড়া দেন কলকাতাবাসীর বৃহত্তর অংশ। সে দিনও আর একটি ‘রাত দখলের অভিযান’ হয়। ওই ৪ সেপ্টেম্বরই নির্যাতিতার বাবার হাতে ‘পুলিশ টাকা দিতে চেয়েছিল’ দাবি ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়ায়।
চিকিৎসক-আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয় ৯ সেপ্টেম্বর। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি তোলার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু পরের দিনও স্বাস্থ্য ভবনের সামনে কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তার অবস্থানে বসেন। ১৪ সেপ্টেম্বর আচমকাই ওই ধর্নামঞ্চে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। মমতা আন্দোলনকারীদের বলেন, ‘‘আমি নিজে ছুটে এসেছি। আমি আন্দোলনের ব্যথা বুঝি। আর কষ্ট না করে কাজে ফিরুন।’’ তার দু’দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে নবান্নে গিয়েও ফিরে এসেছেন আন্দোলনকারীরা। দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল। বৈঠকের ‘লাইভ স্ট্রিমিং’-এর দাবি জানান আন্দোলনকারীরা। রাজ্য সেই দাবি মানতে চায়নি। তাই শর্তের গেরোয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সে বার সম্ভব হয়নি। ১৪ সেপ্টেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চ থেকে বলেন, ‘আপনাদের কাছে আসা মানে নিজেকে ছোট করা নয়। আমি শেষ চেষ্টা করে গেলাম।’’ সে দিন সন্ধ্যাতেই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠক ডাকা হয়। কিন্তু শেষমেশ সেই বৈঠকও ভেস্তে যায়।
ওই ঘটনার দু’দিন পরে আবার রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব যায় জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে। ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যান আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিরা। বৈঠক হয়। দাবি মেনে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথাও ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে বিনীত গোয়েলের অপসারণের সিদ্ধান্ত। কিন্তু ওই বৈঠকের পরে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান ওঠেনি। ওঠেনি কর্মবিরতিও। বাকি দাবি আদায় পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা শেষে অবশেষে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান প্রত্যাহারের ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। দিনটা ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর। ২১ সেপ্টেম্বর থেকে হাসপাতালের জরুরি পরিষেবায় যোগ দেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
কিন্তু কয়েক দিন পরেই সাগর দত্ত হাসপাতালে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হেনস্থা নিয়ে নতুন করে দানা বাঁধে আন্দোলন। ২৭ সেপ্টেম্বর জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে গণকনভেনশন হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে আবার কর্মবিরতি শুরু হয়।
গত ৫ অক্টোবর থেকে কলকাতার ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশন’-এ বসেছিলেন ছয় জুনিয়র ডাক্তার। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার স্নিগ্ধা হাজরা, কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা, এসএসকেএমের অর্ণব মুখোপাধ্যায়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের তনয়া পাঁজা, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের পুলস্ত্য আচার্য, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়। পর দিন, ৬ অক্টোবর ধর্মতলায় অনশনে যোগ দেন আরজি কর হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতো। একই দিনে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ‘আমরণ অনশন’-এ বসেন সেখানকার উত্তরবঙ্গ ডেন্টাল কলেজের সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের অলোক বর্মা।
১০ অক্টোবর অনশনকারীদের মধ্যে অনিকেত অসুস্থ হয়ে পড়েন। আরজি কর হাসপাতালেই ভর্তি করানো হয় আরজি করের ওই পড়ুয়াকে। পরের দিন, ১১ অক্টোবর অনশনে বসেন আরও দুই জুনিয়র ডাক্তার। তাঁরা হলেন ভিআইএমএস (শিশু মঙ্গল) হাসপাতালের পরিচয় পণ্ডা এবং কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের আলোলিকা ঘড়ুই। ১২ অক্টোবর ধর্মতলায় অসুস্থ হয়ে পড়েন অনুষ্টুপ। তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়। ওই দিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে অসুস্থ হয়ে পড়েন অলোক। তাঁকে ওই মেডিক্যাল কলেজেই ভর্তি করানো হয়। ১৩ অক্টোবর ধর্মতলায় অসুস্থ হয়ে পড়েন পুলস্ত্য। তাঁকে নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়। ১৪ অক্টোবর অসুস্থ হয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন তনয়া। ওই দিনই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে অনশনে বসেন সন্দীপ মণ্ডল। ১৫ অক্টোবর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনশনকারী সৌভিক। ওই দিনই ধর্মতলায় নতুন করে অনশনে বসেন অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থের রুমেলিকা কুমার এবং মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের স্পন্দন চৌধুরী। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল সূত্রে খবর, ১৬ অক্টোবর ছুটি পান অলোক। ১৮ অক্টোবর উত্তরবঙ্গের হাসপাতাল থেকে ছুটি পান সৌভিক। ১৯ অক্টোবর কলকাতার নীলরতন হাসপাতাল থেকে ছুটি পান পুলস্ত্য।
২১ অক্টোবর নবান্নে বৈঠকের পর ১৭ দিনের অনশন প্রত্যাহার করলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কিন্তু তাঁদের দাবি, সরকার বা প্রশাসনের কথায় কিংবা আলোচনায় প্রেক্ষিতে নয়, ওই সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছেন নির্যাতিতার মা-বাবার আবেদনে এবং রাজ্যের মানুষের কথা ভেবে। অনশন উঠলেও আন্দোলন জারি থাকবে বলে ঘোষণা করেছেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা। পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে আগামী শনিবার। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ‘মহাসমাবেশ’-এর আহ্বান করেছেন আন্দোলনকারীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy