সহাবস্থান: পুরভোটের আগে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দলের পতাকা। মঙ্গলবার, বড়বাজারে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
প্রতিবন্ধীদের সমাজের সব স্তরে অন্তর্ভুক্ত কি করবে প্রশাসন কলকাতা আমার প্রাণের শহর। এই শহর আমাকে কী দিল আর আমার থেকে কী নিল, তার হিসাবনিকাশ নিয়ে কোনও দিন ভাবিনি। কিন্তু যে দিন প্রথম হুইলচেয়ারে মেয়েকে বসিয়ে রাস্তায় বেরোলাম, চেনা শহরটা যেন অচেনা হয়ে গেল। এই শহর, এর বড় রাস্তা, ছোট রাস্তা, অলিগলি— কোনওটাই হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়ার মতো নয়। অসমান, খানাখন্দে ভরা রাস্তায় খাবি খায় হুইলচেয়ার ও তাতে বসে থাকা ছোট্ট রাই।
ওকে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই বাঁশদ্রোণী বা গড়িয়াহাট সুপার মার্কেটে। কোনওটাই হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশযোগ্য নয়। হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশযোগ্য নয় রেস্তরাঁ, সিনেমা হল, থিয়েটার হল, স্টেডিয়াম,বইমেলা কিংবা সরকারি অফিস। শুধুমাত্র পাড়ার দুর্গাপুজো নয়, বড় বড় নেতা-মন্ত্রীদের পুজোতেও নেই শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করার ভাবনা। শহরের কোনও গণশৌচাগারে নেই শারীরিক
ভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। মালদহ থেকে আসা, হুইলচেয়ারে বন্দি ১৪ বছরের ঋদ্ধিমা
ভালবাসে বেড়াতে। কলকাতায় এসে যখন সে আবদার করল মেট্রো রেল চড়বে, থমকে যায় অরুণিতা। কী করে সে বোঝাবে, এই শহর প্রতিবন্ধীদের নয়।
স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়েও একই সমস্যা। পরিকাঠামোর অভাব দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কত স্কুল। কেউ হয়তো উপদেশ দিয়েছেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাতে। এই অভিজ্ঞতা আমার মতো অনেক বাবা-মায়ের। এর মধ্যেও মানবিক মুখ দেখিয়েছে কিছু স্কুল। তাই আমাদের বাচ্চারা পড়তে পারছে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ব্যক্তিবিশেষের সিদ্ধান্তভিত্তিক। প্রশাসন কি ভাববে সমাজের প্রতি স্তরে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তিকে বাস্তবায়িত করার কথা?
এ বার বলি, প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে আমাদের বাচ্চাদের আর এক পরিচয়, ওরা বিরল রোগে আক্রান্ত কিছু মুষ্টিমেয় হতভাগ্য। রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার ওদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই। নেই জিনগত রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা। এমন বিরল রোগীদের প্রয়োজন বিভিন্ন বিভাগের পরিষেবা। বাচ্চা বা প্রাপ্তবয়স্ক রোগীকে কোলে করে বা হুইলচেয়ারে বসিয়ে প্রত্যেক বিভাগে লাইন দিয়ে দেখানো এবং কোনও পরীক্ষা দরকার হলে তার তারিখ নিয়ে আবার অন্য দিন আসা। সব বিভাগ চলেও না এক দিনে। মালদহ, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি থেকে প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের ট্রেনে-বাসে করে নিয়েআসা যে কত কষ্টের, তা আমাদের মতো ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না। এদের জন্য কি মাসের কোনও একটা দিন সব বিভাগের বিশেষজ্ঞদের একই ছাদের নীচে পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না?
তিন বছর বয়সের শ্রীতমা পাল বিরল রোগ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফিতে (এসএমএ) আক্রান্ত। ওজন ৩০ কেজি। ওকে কোলে নিয়ে সরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে ঘুরে ঘুরেও প্রতিবন্ধী শংসাপত্র এখনও বানাতে পারেনি ওর মা। ওই শংসাপত্র ছাড়া পাওয়া যাবে না বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্য বিমা। যেটা হলে কিছুটা হলেও সুবিধা হত ওদের। প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র প্রদানের ব্যবস্থা কি আরও খানিকটা মানবিক হতে পারে না?
আর্থিক কারণে শ্রীতমার নিয়মিত ফিজ়িয়োথেরাপি করাতে পারছেন না ওর মা-বাবা। ওকে কোলে নিয়ে, বাসে-ট্রেনে চেপে সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত ফিজ়িয়োথেরাপি করানো সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া, শ্রীতমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। হাসপাতালে নিয়মিত গেলে রয়েছে সংক্রমণের আশঙ্কা। দুয়ারে সরকারের মতো কি দুয়ারে স্বাস্থ্য পরিষেবা জাতীয় কিছু হতে পারে না?
১৪ বছরের স্মৃতি থাকে জলপাইগুড়িতে। স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফিতে আক্রান্ত স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার একলা লড়াই লড়ছেন ওর মা লিপিকা। স্মৃতির মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার দরকার। বেসরকারি হাসপাতালের এক জন অভিজ্ঞ শল্য চিকিৎসক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবুও বাকি খরচটুকু জোগাড় করতে হিমশিম অবস্থা লিপিকার। একই অবস্থা কালীঘাটের বছর ষোলোর অরিজিৎ, ক্লাস নাইনে পড়া মেদিনীপুরের স্বর্ণাভা আর বারো বছরের অনুভবের। স্কোলিয়োসিস অপারেশনের জন্য পাওয়া যায় না সরকারি সাহায্য।
দুর্বল শ্বাসযন্ত্র, বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ড আর প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এই প্রতিভাশালী বাচ্চারা চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াই। এই রোগ প্রতি মুহূর্তে ওদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটাচ্ছে। ওদের প্রয়োজন হুইলচেয়ার, বাইপ্যাপ এবং অন্যান্য যন্ত্র। অনেক মা-বাবা আর্থিক কারণে বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় পরিষেবার ব্যবস্থা করতে পারছেন না। কোনও সরকারি হাসপাতালে ওদের চিকিৎসার কিংবা এই সব যন্ত্র দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বাচ্চাদের হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয় শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে। অনেক সময়েই শয্যা পাওয়া যায় না।
আমাদের বাচ্চাদের কি আর একটু ভাল স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া যায় না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy