রাজ্যে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাগুলির মধ্যে ৬৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই যাত্রীরা সিট বেল্ট ব্যবহার করেননি। ফাইল চিত্র।
ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনা থেকে সম্প্রতি বেঁচে ফিরেছেন পুলিশকর্তা দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে কাজে যোগ দিয়েই গত ৩০ অক্টোবর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন ডাম্পারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুমড়ে যাওয়া তাঁর গাড়ির ছবি। সেই সঙ্গে লিখেছেন, কী ভাবে তাঁকে এবং তাঁর তিন সহযাত্রীকে এ যাত্রায় বাঁচিয়েছে সিট বেল্ট! তাঁর আবেদন, ‘গাড়ির সামনের আসনে বসুন বা পিছনের, সিট বেল্ট অবশ্যই পরে থাকুন।’ যদিও প্রশ্ন উঠেছে, সিট বেল্ট পরা নিয়ে কড়াকড়ির পরিবর্তে কেন তা আবেদন-অনুরোধের পর্যায়ে আটকে থাকে? খোদ পুলিশকর্তার এমন অভিজ্ঞতার পরেও কেন সিট বেল্ট না পরলে জরিমানার কড়াকড়ি করা হয় না?
এই প্রশ্নই জোরালো হয়েছে পথ দুর্ঘটনায় টাটা সন্সের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রির মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক রাজ্যে কড়াকড়ি চালু হওয়ায়। যেমন, মুম্বইয়ে আগামী ১০ তারিখ থেকে গাড়ির সব যাত্রীকেই বাধ্যতামূলক ভাবে সিট বেল্ট বাঁধতে হবে। জোর দেওয়া হচ্ছে পিছনের আসনের যাত্রীর সিট বেল্ট পরার উপরেও। না-হলে হাজার টাকা জরিমানা। প্রয়োজনে পুলিশ যাত্রীপিছু আরও ২০০ টাকা করে জরিমানা করতে পারে। আগামী ১৪ নভেম্বর থেকে একই পথে হাঁটতে চলেছে হায়দরাবাদও। কর্নাটকও পিছনের আসনের যাত্রীর সিট বেল্ট বাঁধা নিয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছে।
কিন্তু মুম্বই পারলেও কলকাতা পারে না কেন— নতুন করে এই প্রশ্ন উঠছে। কর্নাটকও এ নিয়ে কড়াকড়ি করছে। তবু পশ্চিমবঙ্গের হেলদোল নেই কেন, সেটাই বড় প্রশ্ন।
পথ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত পুলিশি রিপোর্ট চিন্তা আরও বাড়াচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, দুর্গাপুজোর চার দিন এবং কালীপুজোর আগের দিন থেকে দীপাবলি পর্যন্ত হাইওয়েতে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। রাজ্যে ওই ক’দিনে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাগুলির মধ্যে ৬৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই যাত্রীরা সিট বেল্ট ব্যবহার করেননি। মৃতদের মধ্যে ৮২ শতাংশই ছিলেন গাড়ির পিছনের আসনে বসা যাত্রী।
পরিবহণ মন্ত্রকের পথ নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, যেখানে এয়ার ব্যাগ মৃত্যুর ঝুঁকি ৬৩ শতাংশ কমাতে পারে, সেখানে সিট বেল্ট তা কমাতে পারে ৭২ শতাংশ। আর এই দু’টিরই ঠিকঠাক ব্যবহার মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে পারে প্রায় ৮০ শতাংশ। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মোট ৬৩.৯ লক্ষ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে মূলত জাতীয় সড়ক ১.৩৩ লক্ষ কিলোমিটার (মাত্র ২.১ শতাংশ)। দেশের মোট পথ দুর্ঘটনার ৩০.৩ শতাংশ ঘটে সেখানেই! ২৩.৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে রাজ্য সড়কে (১.৮৭ লক্ষ কিলোমিটার, মোট রাস্তার প্রায় ২.৯ শতাংশ)। বাকি ৪৫.৮ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে অন্যান্য রাস্তায়।
সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’র (এনসিআরবি) রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে দেশে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬২২ জনের। অর্থাৎ, প্রতি ঘণ্টায় মৃত্যু ১৮ জনের। মৃত্যুর কারণ হিসাবে ৬৮ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী অত্যধিক গতি এবং বেহাল পথ। সেই সঙ্গে রয়েছে গাড়ির সিট বেল্ট না পরার উদাসীনতাও।
কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বললেন, ‘‘১৯৯৪ সালের মার্চ থেকে দেশে তৈরি সব গাড়িতেই সিট বেল্ট থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০২ সাল থেকে পিছনের আসনের যাত্রীদের সিট বেল্ট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এর ২০ বছরেরও বেশি সময় পরেও এ নিয়ে উদাসীনতার চিত্রটা বদলায়নি। তাই আরও বেশি করে কড়া আইন প্রয়োগ করে জরিমানার পথে হাঁটতে হবে।’’ কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের এক কর্তা জানান, ‘কেন্দ্রীয় মোটর ভেহিক্ল রুল’-এর (সিএমভিআর) ১৩৮ (৩) ধারা অনুযায়ী, সামনের আসনে বসা যাত্রী এবং অনধিক আট জনকে নিয়ে চলতে পারে, এমন গাড়ির সামনের দিকে মুখ করে বসা, পিছনের আসনের যাত্রীদের সিট বেল্ট পরে থাকতেই হবে। অন্যথায় পুলিশ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারে। বার বার এই আইনভঙ্গ করলে জরিমানার অঙ্কও বাড়তে পারে।
কিন্তু আদৌ এই জরিমানার কড়াকড়ি হয় কি? পুলিশের একাংশের দাবি, ‘‘এখনও এ রাজ্যে বুঝিয়ে কার্যোদ্ধারের পথেই হাঁটা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy