ক্যানসারে বাদ গিয়েছিল একটি হাত। তার পরেও জীবনটা থেমে যায়নি। বরং ছবি আঁকার সূত্রে পরিচয় হওয়া তরুণী তাঁর দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিলেন দেগঙ্গার তরুণ দেবরাজ চট্টোপাধ্যায়ের বেঁচে থাকা আর একটি হাত। আট বছর আগের সেই হাতের-বন্ধন আজও অটুট। স্ত্রী সুস্মিতা চক্রবর্তী চট্টোপাধ্যায়ের থেকে পাওয়া মানসিক জোরেই আজও ক্যানভাসে জীবন জয়ের গল্প রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তোলেন দেবরাজ।
শিশু ক্যানসার রোগীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘লাইফ বিয়ন্ড ক্যানসার’ আয়োজিত পঞ্চম বার্ষিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে এসে জীবন-যুদ্ধে জয়ের স্বাদ ভাগ করে নিলেন দেবরাজ-সুস্মিতা। এক জন ক্যানসার আক্রান্তকে রোগের সঙ্গে লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি মানসিক জোর দিতে পারেন তাঁর কাছের মানুষ কিংবা অভিভাবকেরা। তাই সেই সব অভিভাবকদেরও এ দিন মঞ্চের স্পট লাইটের নীচে নিয়ে এল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আট জন শিশুর মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হল সংবর্ধনা। সেই তালিকাতেই যুক্ত ছিলেন সুস্মিতাও। বললেন, ‘‘দেবরাজের সঙ্গে সমস্ত অনুষ্ঠানেই আমি যাই। যাতে আর পাঁচ জন জানতে ও বুঝতে পারেন ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষেরও স্বাভাবিক জীবন, নিরোগ স্ত্রী থাকতে পারেন।’’ ওই তরুণীও পেশায় চিত্রশিল্পী। দু’জনে মিলে তৈরি করেছেন অঙ্কন শিক্ষাকেন্দ্র ‘রঙিন দিগন্ত’।
ঠিক সময়ে ধরা পড়লে এবং তার যথাযথ চিকিৎসা হলে ক্যানসার আক্রান্ত এক জন শিশুর জীবনও আর পাঁচ জনের মতোই রঙিন হয়ে উঠতে পারে। সেই লক্ষ্য থেকেই শহরের চারটি সরকারি হাসপাতাল এবং বিভিন্ন বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করছে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্থার তরফে পার্থ সরকার বলেন, ‘‘জেলা থেকে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা বহু শিশু শহরে আসে চিকিৎসা করাতে। কোনও ভাবেই যাতে মাঝপথে তাদের চিকিৎসা বন্ধ না হয়, সেটায় জোর দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। তাই ওই সব হাসপাতালে আমাদের সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে মায়েদের থাকার দুটি জায়গাও করেছি।’’
কড়া ডোজ়ের ওষুধ, কেমোথেরাপির পরে সুস্থ জীবনে যখন একটা শিশু ফিরতে থাকে, তখন তাকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজও করে পার্থদের সংস্থা। সেই লক্ষ্যেই প্রতি বছরের মতো এ বারও রবীন্দ্র সদনে আয়োজন করা হয়েছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। যেখানে ‘ও যে আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না’ গানে অন্যদের সঙ্গে একই ছন্দে তাল মিলিয়ে ক্যানসার জয়ীরাও নৃত্য পরিবেশন করলেন। এ ছাড়াও আলোকিত মঞ্চে একের পর এক গানে নৃত্য উপস্থাপনা করলেন তাঁরা।
‘আজ ও কাল’ এই ভাবনাতেই আয়োজিত গোটা নৃত্যানুষ্ঠানের জন্য ক্যানসার জয়ীদেরও তালিম দিয়েছিলেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও তাঁর নৃত্যগোষ্ঠী। একই ভাবে শিশু ক্যানসার রোগীদের পাশে থাকতে সঙ্গীত শিল্পী আরমান রশিদ খান, অনীক ধর, অভিনেত্রী দেবলীনা দত্তেরা গান-নাচ মঞ্চস্থ করলেন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক চৈতী ঘোষাল ও সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বার বার তুলে ধরলেন জীবনের জয়গানের কথা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)