লড়াকু: বাড়িতে সৌভিক। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
দশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও ভাল করে কথা বলতে পারেন না ২৯ বছরের সৌভিক। স্বাভাবিক হাঁটাচলাও বন্ধ। গত দশ বছর ধরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করা এন্টালির এই যুবকের মনে যে ক্ষোভ জমে ছিল, গত মঙ্গলবার তা খানিকটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। তাঁর এমন অবস্থার জন্য যারা দায়ী বলে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, এত বছরের আইনি লড়াইয়ের পরে বেঙ্গালুরুর আদালত সেই দুই যুবককে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে।
সৌভিক চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের গত দশ বছর রুপোলি পর্দার চিত্রনাট্যের থেকে কোনও অংশে কম নয়। কলকাতার প্রাথমিক পাঠ শেষ করে ২০০৯ সালে বেঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন তিনি। তখন বয়স ১৮। আর কে পুরমের কাছে সহপাঠী শশাঙ্ক দাসের সঙ্গে ভাড়া নিয়েছিলেন একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে ছিল আরও এক সহপাঠী বন্ধু, বয়সে একটু বড় জিতেন্দ্র সাহু।
সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু, এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা নিয়ে সৌভিক ও শশাঙ্কের মধ্যে গোলমাল বাধে। ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর জিতেন্দ্র এবং আরও দুই স্থানীয় যুবককে নিয়ে শশাঙ্ক বিষয়টি মিটমাটের জন্য সৌভিককে ডেকে ওই তিনতলা বাড়ির ছাদে নিয়ে যায়। এর কিছু ক্ষণ পরেই সেই বাড়ির নীচে গুরুতর জখম অবস্থায় পড়ে থাকা সৌভিককে দেখতে পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশে খবর দেন। কলকাতাতেও খবর আসে। বাবা সুনীল ও দিদি সোমদত্তা পৌঁছে যান বেঙ্গালুরুতে। হাসপাতালে গিয়ে শোনেন, সৌভিক কোমায়। স্থানীয় পুলিশ একটি দুর্ঘটনার মামলা রুজু করে।
বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে দু’মাস থাকার পরে সৌভিককে ওই অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। প্রথম আট মাস তিনি কোনও ঘটনার কথাই মনে করতে পারেননি। জড় পদার্থের মতো শুয়ে ছিলেন। আঘাত ছিল মাথায়, শিরদাঁড়ায়। কিন্তু, আট মাস পরে মনে পড়ে যায় ঘটনার কথা। তখনও অবশ্য তিনি কথা বলতে পারেন না। বেঙ্গালুরু থেকে তদন্তে কলকাতায় আসে সেখানকার পুলিশ। নিজের ল্যাপটপ থেকে শশাঙ্কের ছবি বার করে নিজের হাতে একটি স্কেচ করে সৌভিক বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাঁকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
সেই স্কেচের ভিত্তিতে পুলিশ খুনের চেষ্টার মামলা রুজু করে এবং শশাঙ্ক ও জিতেন্দ্রকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ২০১২ সালে পুলিশের চার্জশিটে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। মামলাও খারিজ হয়ে যায়। যদিও তাতে হাল ছাড়েনি সৌভিকের পরিবার। শশাঙ্কের বাড়ি অসমে। জিতেন্দ্র ওড়িশার বাসিন্দা। সৌভিকের দিদি নিজে খবরাখবর নিতে ২০১৬ সালে অসমে যান। সোমদত্তা বলেন, “অসমে এক আইপিএস অফিসারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি সাহায্য করেন। সেখানেই আবার নতুন করে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ঘটনাচক্রে, ওই আইপিএস অফিসারের ব্যাচমেট তখন বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার। যোগাযোগ করা হয় তাঁর সঙ্গেও। অসমের মামলা স্থানান্তরিত হয় বেঙ্গালুরুতে। সৌভিকের মামলা আবার শুরু হয়।”
নতুন মামলায় সৌভিকের এঁকে দেওয়া সেই স্কেচ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে আদালতে পেশ করে পুলিশ। বিচার শেষে গত মঙ্গলবার বেঙ্গালুরু আদালতের বিচারক ওই দু’জনকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি এক লক্ষ টাকা করে জরিমানাও করেছেন। তাঁর নির্দেশ, ওই দু’লক্ষের মধ্যে ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা সৌভিকের পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। এ ছাড়াও, চাইলে সৌভিকের পরিবার আলাদা ভাবে ক্ষতিপূরণের দাবি জানাতে পারেন। শশাঙ্ক ও জিতেন্দ্রকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয়েছে জেলে। শশাঙ্ক দিল্লির একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে এবং জিতেন্দ্র বেঙ্গালুরুতেই একটি আইটি সংস্থায় চাকরি করছিলেন।
সোমদত্তা জানিয়েছেন, তাঁর ভাইয়ের চিকিৎসা চলাকালীন এখনও পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। সেই খরচ জোগাতে তাঁর বাবাকে অনেকটা সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy