এখন যেমন, ১৯৭১ সালেও তেমন, আনন্দবাজার পত্রিকা ছিল পশ্চিমবঙ্গের সেরা এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পরবর্তী কালে অনেক বাংলা পত্রিকা বেরিয়েছে, কিন্তু তা জনপ্রিয়তায় আনন্দবাজার পত্রিকার সমকক্ষ হতে পারেনি।
এই ইতিহাস বর্ণনার কারণ এই যে, বাঙালির বিভিন্ন সঙ্কটমুহূর্তে আনন্দবাজার পত্রিকা বাঙালির পক্ষ নিয়েছে। যদিও পরবর্তী কালে রাজনৈতিক ভাবে অনেকে আনন্দবাজার পত্রিকার মতামত পছন্দ করেনি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় আবেগের বন্যায় সব ভেদাভেদ মুছে যায়। নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত হয় যুদ্ধ-পূর্ব ও প্রাক্-১৯৪৭ বাঙালি প্রজন্ম।
১৯৭১ সালের শুরু থেকে, বিশেষ করে মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন কোনও দিন যায়নি, যে দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু ছাপা হয়নি। প্রতি সপ্তাহে দু’তিনটি করে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। আবেগতাড়িত বহু সংবাদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সন্দেহ নেই, আনন্দবাজার পত্রিকা সর্বতো ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাশে ছিল।
পাঠকদের সুবিধার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলিকে বেশ ক’টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলি হল: অবরুদ্ধ বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ত্রাণ ও শরণার্থী, পাকিস্তান, ভারত, পাক-ভারত যুদ্ধ, মুজিবনগর সরকার, অন্যান্য রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং স্বীকৃতি, প্রবন্ধ, উত্তর-সম্পাদকীয়, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়। তবে, এগুলি একেবারে সীমাবদ্ধ কোনও ভাগ নয়। একই সংবাদ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সময়কাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল অবরুদ্ধ। এরই মধ্যে মানুষ সাহস পেত বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর থেকে, স্বাধীন বাংলা বেতার ও বিবিসি এবং অন্যান্য বিদেশি বেতার থেকে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের খবর পাওয়ার জন্য পত্রিকাগুলিকে নির্ভর করতে হত বিদেশি সংবাদ সংস্থা, শরণার্থী, ফিরে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা বা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে কখনও কখনও সংবাদদাতারা প্রবেশ করতে পেরেছেন এবং খবর পাঠিয়েছেন নিজ পত্রিকায়। আনন্দবাজার পত্রিকাও এর ব্যতিক্রম নয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালে এই পত্রিকায় ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ’ সংক্রান্ত সংবাদগুলিতে উপযুক্ত আলোচনার প্রতিফলন দেখি সংবাদের ক্ষেত্রে। কিছু কিছু খবর ছিল উড়ো খবর। এ ধরনের খবর তখন প্রায়ই পাওয়া যেত। কিছু কিছু ছিল অতিরঞ্জিতও। সে অতিরঞ্জন হয়তো নিহতের সংখ্যায় বা খুঁটিনাটি বিবরণে। আনন্দবাজারের খবরে আমরা ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ’-এর মোটামুটি একটি চিত্র পাই।
শেখ মুজিবের গ্রেফতার ও বিচারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত ও ভারতের বাইরে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, আনন্দবাজারে তার পরিচয় পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাপী জনমত ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আর এগোতে পারেননি। নেতার অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জ়ুলফিকর আলি ভুট্টো শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকায় ফেরেন। ঢাকার রেসকোর্স মাঠে তিনি সে দিন যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার একটি আবেগী রিপোর্ট আছে এই সঙ্কলনে।
শরণার্থীর বিষয়টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ১৯৪৭-এর পর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু মানুষ বাস্তুভিটা ত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছিলেন। এ সংখ্যা পরে শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করে। কত শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার যথার্থ হিসাব না পেলেও ভারতীয় হিসাব অনুযায়ী সে সংখ্যা ৯৮,৯৯,৩০৫ জন। এটি হচ্ছে ক্যাম্পের হিসাব। কিন্তু ক্যাম্পের বাইরেও ছিলেন অনেক শরণার্থী। সেই হিসাব ধরলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটির উপর শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনও দেশ থেকে এত মানুষ শরণার্থী হননি।
শরণার্থীদের সমস্যা ও তাঁদের যাঁরা সহায়তা করেছিলেন, সে সংবাদ আনন্দবাজার পত্রিকায় যথেষ্ট ছাপা হয়েছে। এটিই যে পুরো চিত্র, তা নয়। তবে, পরিস্থিতিটা অনুভব করা যায়। আমেরিকার সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি শরণার্থীদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শরণার্থী শিবিরে তাঁর সফরের বিবরণ আনন্দবাজার পত্রিকা গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছিল। এখানে উল্লেখ্য, শরণার্থীরা স্থায়ী ভাবে ভারতে বসবাস করতে চাননি। সহায়ক অবস্থার সৃষ্টি হলে তাঁরা দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ নামেই পরিচিত। অনেকে একে ‘প্রবাসী সরকার’ও বলেন। তবে, বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার বলাটাই শ্রেয়। এ সরকারের অধীনে জনযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। বাংলাদেশ সরকার গঠন থেকে শুরু করে এর নির্দেশাবলি ও কার্যক্রম সংক্রান্ত সংবাদও আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ পর্যায়ের প্রথম সংবাদটি বাংলাদেশ সরকার গঠন নিয়ে। আনন্দবাজার পত্রিকা এক আবেগপূর্ণ দীর্ঘ রিপোর্ট ছেপেছিল ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১। আনন্দবাজারে সাধারণত এত বড় প্রতিবেদন ছাপা হত না। এর শিরোনাম ছিল: ‘নতুন রাষ্ট্র নতুন জাতি জন্ম নিল’।
“একটি রাষ্ট্র আজ সকালে আনুষ্ঠানিক ভাবে জন্ম নিল। এই নতুন নগরে— সে রাষ্ট্রের নাম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার জন্মলগ্নে আকাশে থোকা থোকা মেঘ ছিল। তার জন্মলগ্নে চারটি ছেলে প্রাণ ঢেলে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গাইল। তার জন্মলগ্নে পবিত্র কোরান থেকে তেলাওয়াৎ করা হল। তার জন্মলগ্নে সহস্র কণ্ঠে জয়ধ্বনি উঠল ‘জয় বাংলা’।” বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে পরিবেশনের জন্য তৈরি প্রতিবেদনটি গুরুত্বপূর্ণ।
এই সরকারের পরিণতির দিনটি ধরতে পারি ২৩ ডিসেম্বর। স্থান ঢাকা। আনন্দবাজারের ২৪ ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে আছে, “পুরোনো পল্টনের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আজ ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের দশহাজার কর্মচারী হাত তুলে শপথ নিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে দেশ পুনর্গঠনের জন্য তাঁরা জীবন উৎসর্গ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শ্রী তাজুদ্দিনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওঁরা বলেছেন, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।”
মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের কর্মকাণ্ডের খবরাখবর সঙ্কলিত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে কী ঘটছে, তার খবরাখবর প্রধানত সংবাদ সংস্থাগুলি যা দিয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা এখানে তার উপরেই নির্ভর করেছে।
২৫ মার্চের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। বাংলাদেশে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ বিবরণ আনন্দবাজার প্রথমে ছাপে (৫ এপ্রিল ১৯৭১)। এ ধরনের কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পরবর্তী কালে আরও ছাপা হয়েছিল। আনন্দবাজার সাধারণত দীর্ঘ সংবাদ ছাপত না। কিন্তু ঐতিহ্য ভেঙে ১৯৭১ সালে তারা একটি দীর্ঘ রিপোর্ট ছাপে ‘‘মুজিবের কাছে অনুরোধ সিন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে এক হতে চায়’’ শিরোনামে। এ ধরনের খবর অন্য কোথাও আমার চোখে পড়েনি। যিনি এই খবরটি পাঠিয়েছিলেন, সেই অনিল ভট্টাচার্য এখন প্রয়াত। আগে এই রিপোর্টটি চোখে পড়লে হয়তো তাঁর থেকে সত্যাসত্য জানতে পারতাম।
‘পাকিস্তান’ সংক্রান্ত সংবাদে ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো সংক্রান্ত খবরেরই ছিল প্রাধান্য এবং সেটি স্বাভাবিক। কারণ, পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্চ-এপ্রিলে তাঁরাই ছিলেন প্রধান। এর পর আস্তে আস্তে লক্ষ করি, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়ার নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ইয়াহিয়া ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন এবং ভুট্টো ক্রমেই নিজের ক্ষমতা সম্পন্ন করছেন। যদিও সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতৃবৃন্দ তাঁর আধিপত্য পছন্দ করছিলেন না।
ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালিদের প্রতি ভালবাসা ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক্ষেপের সংবাদ প্রতিবেদন ‘ভারত’ শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। উপরে যে আলোচনা করেছি, তা এই সংবাদ প্রতিবেদন পড়লেই স্পষ্ট হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যারা ছিলাম অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, তাদের অধিকাংশের প্রধান প্রার্থনা ছিল— ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কবে বাধবে। আজ চতুর্দিকে পাকিস্তান আমলের মতো ভারত-বিরোধিতা দেখি, যা বিএনপি ও দক্ষিণপন্থী দলগুলি উস্কে তুলছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে আর্তিটি ছিল— ভারত কি আমাদের শরণার্থীদের সাহায্য করবে, অস্ত্র দেবে, থাকতে দেবে? এই সব অনুভূতি আজ অনেকেই অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু তা-ই ছিল সত্য। এবং সেই পটভূমিকাতেই ১৯৭১ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধকে বিচার করতে হবে।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, ইন্দিরা গাঁধী কলকাতায় এসেছিলেন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন ও জনসভায় বক্তৃতা দিতে। এ সময়ই তিনি জানতে পারেন পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দিল্লি ফিরে যান ও যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ভারত এই প্রথম বার পূর্ব ও পশ্চিম দুই সীমান্তে যুদ্ধ শুরু করে জেনারেল মানেকশ-র নেতৃত্বে। অচিরেই বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়, কারণ গত যুদ্ধগুলি হয়েছিল এক (পশ্চিম) সীমান্তে। সে জন্য পাকিস্তান কিছু সময় টিকে থাকতে পেরেছিল। পূর্ব সীমান্তে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা এসে পৌঁছয়। জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। ঢাকায় রমনার মাঠে ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বস্তুত, পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণ এই যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে এবং ভারত ও পূর্ব সীমান্তে প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে সহায়তা করার সুযোগ পায়। বলা যেতে পারে, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছিল।
‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ শিরোনামে আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছে সীমান্ত সংঘর্ষ, বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ও আসন্ন যুদ্ধের খবরাখবর। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই তা স্বীকৃতির চেষ্টা করেছে।
অন্য দিকে, ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও বার বার দাবি তুলেছিল বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য, যদিও এক ধরনের ‘ডি ফ্যাক্টো’ স্বীকৃতি ভারত দিয়েছিল, কারণ ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সরকার গঠন করতে দিয়েছিল তার মাটিতে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করেছিল ও অস্ত্রশস্ত্র জুগিয়ে যাচ্ছিল। যদিও আইনগত স্বীকৃতি ভারত তখনও দেয়নি। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিল, যা ছিল এক ধরনের স্বীকৃতি। যুদ্ধ শুরু হলে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তার পর ভুটান। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে স্বীকৃতির আবেদন জানায়। এ সংক্রান্ত খবরাখবরের কমতি নেই।
আনন্দবাজারে নিয়মিত সাহিত্য বিভাগ (রবিবাসরীয়, এমনকি আনন্দমেলা-ও) ছাড়াও বিভিন্ন সময় বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখকরা বাংলাদেশের বাঙালিদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বনফুল, মনোজ বসু, রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ চৌধুরী, পূর্ণেন্দু পত্রী, মতি নন্দী— কে লেখেননি? বাংলাদেশের যাঁরা তখন কলকাতায় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে স্বনামে আবদুল গাফফার চৌধুরী ও হাসান মুরশিদ নামে গোলাম মুরশিদ নিয়মিত লিখেছেন। পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের অনেকেই ছিলেন আদিতে পূর্ববঙ্গের, ফলে এক ধরনের নস্ট্যালজিয়াবোধেও তাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁদের লেখাতেও এর পরিচয় পাওয়া যাবে। কবিতাও লিখেছেন অনেক।
ওদের সংগ্রামের দিকে তাকিয়ে নামে একটি সিরিজ় বেরিয়েছিল, যাতে লিখেছিলেন রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বক্তব্য একই, যেটি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখায়, “নিজের নানা অক্ষমতার কোটরে বসে আছি আজও, অদূরে কুরুক্ষেত্র-ন্যায় ধর্মের যুদ্ধ। আমি কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু আমার মন অবিরল প্রার্থনা করে— বাংলাদেশ এ বার মুক্ত হোক। বাঙালির ভালবাসা পাক দুর্ভাগা বাংলাদেশ।” (৪ এপ্রিল ১৯৭১)।
হাসান মুরশিদ লিখেছেন আনন্দবাজারে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের কাছে বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি নামে পাঁচটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, বাংলা একাডেমি, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড প্রভৃতির পরিচয় তুলে ধরেছেন। মননশীল প্রবন্ধ লিখেছেন প্রবোধকুমার সান্যাল, গৌরী আইয়ুব, শিবদাস চক্রবর্তী, সমর গুহ প্রমুখ। মার্চ-এপ্রিলের লেখায় দেখি বাঙালিরা মধ্যে-মধ্যে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। কেন ভারত সাহায্য করছে না, কেন বিশ্ব জনমত তখনও জোরালো নয় ইত্যাদি। নিখিল সরকার ঠিকই মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘নবীন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নবীন জাতীয়তার মরণপণ লড়াই’’ (২৮ মার্চ ১৯৭১)। এবং হতাশার সুরে বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলা যেন দ্বিতীয় বারের মতো এই জাতিকে (পশ্চিমবঙ্গ) পাতকী না করে।”
রমাপদ চৌধুরী লিখলেন, “মুজিবুরের বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর মুখোশ খুলে দিয়েছে।” কারণ, সবাই ‘ফ্যাসিজমের দোস্ত’ (৪ এপ্রিল ১৯৭১)। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখলেন, “আজ ‘বাংলাদেশ’ সাক্ষী, সামরিক শক্তি কোন জগদ্দল বোঝা আদৌ নয়, বিশালতম কোন অচলায়তনও নয়— জনগণ ইচ্ছে করলে তাকেও উৎখাত করতে পারে। প্রমাণ হল গণতন্ত্রই সভ্যতার প্রকৃত নিয়ামক।” (২৭ এপ্রিল ১৯৭১)। গৌরী আইয়ুব লিখেছিলেন, “এই সংগ্রামের নায়ক মুজিবুর রহমান এক দিন বিশ্বের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বলে গণ্য হবেন কারণ শুধু পূর্ব বাংলার মুসলমানকে নয়, সারা ভারতের মুসলমানকেই তিনি এক মহত্তর পথের সন্ধান দিচ্ছেন।” (৩ মে ১৯৭১)। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “দুই বাংলার এক হওয়ার বিরুদ্ধে দু’দিকেই মানসিক প্রতিরোধ কম নয়। ...আগ্রহটা দু’দিকেই মুখ্যত সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও হার্দিক সম্পর্ক স্থাপনের দিকে, রাজনৈতিক ঐক্য সাধনের পক্ষে ততটা নয়।” উপসংহারে লিখেছেন, “যারা এই বীরকে (মুজিব) শ্রদ্ধা করতে পারছে না, এই বীরত্বের গৌরবে নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করছে না তারা বড় হতভাগ্য।” এখনও এ মন্তব্য প্রাসঙ্গিক।
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুত্ব অটুট কারণ, “বাংলাদেশের দুর্দিনে ভারত তার জন্য যা করেছে আর কেউ তা করেনি, করতে পারত না।” ঠিকই বলেছেন, কিন্তু বাংলাদেশ ওই কথা মনে রাখেনি।
উত্তর-সম্পাদকীয়ের সুরও ছিল এক তারে বাঁধা। অস্পষ্ট খবরাখবরের জন্য সাংবাদিকরা তখনও নিশ্চিত নন যে ঠিক কী ঘটছে, কিন্তু এক বার যখন নিশ্চিত হলেন, তখন তাঁরা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে নিজেদের সংগ্রাম করে নিলেন। অধিকাংশ উত্তর-সম্পাদকীয় পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরাই লিখেছেন। বাইরের লেখাও ছাপা হয়েছে। বেশি লেখা চোখে পড়েছে রণজিৎ রায়, পান্নালাল দাশগুপ্ত, ইন্দ্রনীল, বরুণ সেনগুপ্ত, শংকর ঘোষ, খগেন দে সরকার, সন্তোষকুমার ঘোষ প্রমুখের। উত্তর-সম্পাদকীয়গুলি ধারাবাহিক ভাবে পড়লে দু’টি বিষয় নজরে পড়ে। এক, ভারত সরকারের স্ট্র্যাটেজি ও দৃষ্টিভঙ্গি কী ভাবে বদলাচ্ছে। দুই, জনমত বাংলাদেশের পক্ষে কী ভাবে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে।
সন্তোষকুমার ঘোষের মতো সতর্ক সাংবাদিকও এক সময় লিখেছিলেন, বাংলাদেশে থাকলে তিনিও ‘বিপুল আবেগে আপ্লুত’ হয়ে যেতেন। “আমাদের যখন বয়স কম, তখন এই কলকাতাতে শুনেছি, অনেকেই হালকা গলায় বলে ‘বাঙালী না মুসলমান?’ এই অর্থহীন প্রশ্নের সার্থক উত্তর ওঁরা এত দিনে দিয়েছেন।— আগে বাঙালী, পরে মুসলমান। আমরা প্রস্তাব পাশ করে ‘সেকুলার’ হয়েছি, ওরা কবে যেন, কী করে যেন, বিনা প্রস্তাবে, বিনা প্রস্তুতিতে সবাই সত্যকার ‘সেকুলার’। ওঁরাই বাঙালী, নবজাতীয়তায় জাগ্রত। আমরা এখানে ছোট শরিক মাত্র। শুধু কি জাতীয়ত্ব? ওঁদের বাঙালীত্ব তার চেয়েও বেশি— মনুষ্যত্বের ভিত্তিতে সুকঠিন প্রতিষ্ঠিত। “রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি?”— ভুল ভুল, একেবারে ভুল। সাত কোটি বাঙালীরে ‘জননী’ মানুষও করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ভুলটা ধরা পড়েছে এত দিনে— ওঁরা ধরিয়ে দিলেন, আমরা কৃতজ্ঞ।” (১৩ এপ্রিল ১৯৭১)।
এই ধরনের মন্তব্যে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধকে অন্য বাঙালিরা কী ভাবে দেখেছিলেন এবং আমরাও তখন কী ভেবেছিলাম। কারণ, আমাদের এক ধরনের ভাবনার কারণেই তো এ ধরনের বক্তব্যগুলি এসেছিল, কিন্তু এখন বুঝি, রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও দূরদর্শী ছিলেন ঢের। তাঁর কবিতার উল্লিখিত পঙ্ক্তি যে কত সত্য, তা কি এখন বলার অপেক্ষা রাখে?
সঙ্কলিত ৯৭টি উত্তর-সম্পাদকীয়তে আবেগমথিত আর্তি, আবেদন ছাড়াও যুদ্ধের কলাকৌশল নিয়ে অনেক লিখেছেন পান্নালাল দাশগুপ্ত। স্বীকৃতির প্রশ্ন বার বার এসেছে এবং কোনও স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়েও তিক্ত মন্তব্য করা হয়েছে। অস্ত্র দিয়ে সাহায্যের আবেদন করা হয়েছে। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির পাকিস্তানকে সমর্থনেরও নিন্দা জানানো হয়েছে।
তবে, স্বাধীন হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বরুণ সেনগুপ্ত তাঁর লেখায় যে সব মন্তব্য করেছিলেন, আজ এত বছর পর দেখি সেগুলি প্রমাণিত হয়েছে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকার ক্ষমতায় এলেই আমেরিকা তার স্ট্র্যাটেজি পাল্টাবে। “প্রথমত, তারা চেষ্টা করবে, যাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের ঝগড়া লাগিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, তারা চেষ্টা করবে, যাতে পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং আবার তাকে সাময়িক ভাবে শক্তিশালী করে তোলা যায়। ...যদি আমাদের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা এবং বাংলাদেশ সরকারের সবাই এখন থেকেই সতর্ক না হন, তা হলে এ ব্যাপারে আমেরিকার আংশিক সাফল্য কেউ আটকাতে পারবে না। তারা এখন ভারত-বাংলাদেশ বিরোধের বীজ বপন করতে চাইছে। এ বীজ যদি এক বার তারা পুঁতে ফেলতে পারে, তা হলে ভবিষ্যতে কোনও না কোনও দিন গাছ জন্মাবেই।”
এ মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে। ফলে গিয়েছে দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীটিও— “স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সেখানে নানা বিদেশি শক্তির প্রচণ্ড খেলা শুরু হয়ে যাবে। সেই খেলা তারা চালাতে চাইবে বাংলাদেশের নেতা, অফিসার, জনতা সকলের মাধ্যমে। ...সাড়ে সাত কোটি মানুষের যদি তারা সুষ্ঠু জনকল্যাণমূলক প্রশাসন গড়ে না তুলতে পারে, তা হলে চার পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে নানা গন্ডগোলের দানা বেঁধে উঠবে।”
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা বিপদে না পড়লে নিজেদের ছাড়া কখনও কারও কথায় গুরুত্ব দেন না। তাঁদের অবিমৃশ্যকারিতার ফলাফল তো আমরা এখন ভোগ করছি।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এমন এক দিন যায়নি, যে দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশের উপর সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়নি। সংবাদপত্র জগতে এ ধরনের ঘটনা বিরল। আগেই উল্লেখ করেছি, বিষয়-বক্তব্যে সম্পাদকীয় উত্তর-সম্পাদকীয়তে পার্থক্য ছিল খুব কম। বাংলাদেশের জন্যে তাঁরা আনন্দিত হয়েছেন এবং আশা করেছেন যে সব আদর্শ সামনে রেখে যুদ্ধ হয়েছিল, সেগুলি অক্ষুণ্ণ থাকবে। তবে, মানুষ যেন সতর্ক থাকে। সতর্ক আমরা থাকিনি, ফলে যা হওয়ার তা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চর্চায় আনন্দবাজার পত্রিকা আকর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা থেকে ২৭ খণ্ডে গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত গ্রন্থমালা প্রকাশিত হয়েছে, যার তিনটি খণ্ড আনন্দবাজার থেকে সঙ্কলন।
ট্রাস্টি সভাপতি, ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, বাংলাদেশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy