দক্ষিণবঙ্গ আর উত্তরবঙ্গের মধ্যে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত বিশেষ বাসে ওঠার চেষ্টায় যাত্রীরা। ছবি: পিটিআই।
টিকিট কাউন্টারের মুখ থেকে লাইনটা এঁকেবেঁকে যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। চার পাশে শুধু কালো মাথার ভিড় থিক থিক করছে। কাউন্টারের মুখে পৌঁছনো ভিড়ের অংশ থেকে শোনা যাচ্ছে শুধু চিৎকার: ‘‘ও দাদা, শিলিগুড়ির টিকিট পাওয়া যাবে? মালদা? কোচবিহার..।’’ ধর্মতলায় উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের টিকিট কাউন্টারে বসে থাকা ব্যক্তির মুখে কোনও কথা নেই। কী-ই বা বলবেন! সকালেই তো সব টিকিট শেষ। তাঁকে শুধু এটুকুই বলতে শোনা গেল, ‘‘লাইনে দাঁড়িয়ে থাকুন। খবর এলে বলছি।’’
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের জেরে এখনও উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে ট্রেন চালাচল স্বাভাবিক হয়নি। একের পর এক ট্রেন বাতিলের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। মঙ্গলবারও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে বিক্ষোভ-অবরোধ। ‘টার্গেট’ সেই রেল! ফলে সড়ক এবং আকাশ-পথই ভরসা। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন উত্তরবঙ্গের জন্য অতিরিক্ত ২০টি বাস চালানোর চেষ্টা চলছে। তাতেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। চোখের পলকে ফুরিয়ে যাচ্ছে টিকিট।
চাহিদার তুলনায় সরকারি এবং বেসরকারি বাসের সংখ্যা অনেকটাই কম। সেই সুযোগে দালালচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠার অভিযোগ উঠেছে। চড়া দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা। অন্য দিকে, বিমানের টিকিটের দামও একধাক্কায় আকাশ ছুঁয়েছে। কয়েক দিন আগেও যে টিকিট ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় পাওয়া যাছিল, এখন তার দাম ১১ থেকে ৩৪ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
ধর্মতলায় বাস ডিপোর এক কোণে মুখ গোমড়া করে বসেছিলেন অসমের বাসিন্দা লুকাস বসুমাতারি। সোমবার রাতে তাঁর বন্ধুরা বাড়ি ফেরার জন্য শিলিগুড়ির টিকিট পাননি। শেষ পর্যন্ত এক দালালের কাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায় টিকিট কিনেছেন। লুকাস বলেন, “আমরাও টিকিট পাচ্ছিলাম না। অনেক টাকা চাইছেন দালালরা। হঠাৎ জানতে পারি উত্তরবঙ্গের জন্যে অতিরিক্ত বাস চালানো হচ্ছে। কোনও রকমে একটা টিকিট পেয়ে গিয়েছি। আমি ভাগ্যবান। কিন্তু অনেকেই টিকিট পাচ্ছেন না।”
শল্য চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি কোম্পানিতে কর্মরত অমিত ভাওয়ালকেও উদ্বিগ্ন মুখে ঘুরতে দেখা গেল ধর্মতলা চত্বরে। ওই যুবকের কথায়: “শিলিগুড়ির বিভিন্ন হাসপাতালে শল্য চিকিৎসার সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হয় আমাকে। সপ্তাহে দু’দিন কলকাতা-শিলিগুড়ি করতে হয়। ট্রেনই ভরসা। কয়েক দিন ধরেই যেতে পারছি না। আজও চেষ্টা করে লাভ হয়নি। বিমানের ভাড়া আকাশছোঁয়া। এত টাকা দিয়ে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।”
বিমানে বাগডোগরা যাওয়ার ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে উঠছে তার ভাড়া। কলকাতা-দিল্লির সর্বনিম্ন ভাড়া যেখানে মঙ্গলবার ৬ হাজার ৯২৯ টাকা, কলকাতা-মুম্বই ৭ হাজার ২২৮ টাকা, কলকাতা-হায়দরাবাদ ৮ হাজার ২৪০ টাকা, কলকাতা-জয়পুর ৭ হাজার ৫৫৫, সেখানে সেখানে কলকাতা থেকে বাগডোগরা যাওয়ার ভাড়া পড়ছে ন্যূনতম ১১ হাজার ৫৩৫ টাকা! সর্বোচ্চ ভাড়ার নিরিখেও বাগডোগরা এগিয়ে রয়েছে বেশ কয়েক গুণ, প্রায় ৩৪ হাজার টাকা! দক্ষিণবঙ্গ আর উত্তরবঙ্গের মধ্যে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরেই বিমানের টিকিটের চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে দামও।
বাস ভাড়া নিয়ে যে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছেন, তা পরিবহণ দফতরের কর্তা-ব্যক্তিদের কানেও গিয়েছে। তাই বুধবার পাঁচটি বাড়িয়ে মোট ২৫টি অতিরিক্ত বাস চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের ধর্মতলা ডিপোর ইনচার্জ অনিল অধিকারী এ দিন বলেন, “মঙ্গলবার অতিরিক্ত ২০টি বাস শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারের জন্য চালানো হচ্ছে।’’ ভাড়ার কথাও তিনি জানিয়েছেন, নন এসি (সাধারণ বাস) ৪৫০ টাকা, রকেট বাস ৪৮৬ টাকা, পুশ ব্যাক রকেট বাসের ভাড়া ১ হাজার ১০০ টাকা। তবে অনিলবাবুর দাবি, ‘‘ভলভো বাসের ভাড়া বিমানভাড়ার মতোই চাহিদা অনুযায়ী বাড়ে কমে।” অ্যাপ নির্ভর বাসের ভাড়াও ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকার আশেপাশে রয়েছে।
উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রেল পথে যোগাযোগ কবে ফের শুরু হবে? এ বিষয়ে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক নিখিল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘উত্তর-সীমান্ত রেলের তরফ থেকে এখনও ট্রেন চলানো যাবে কি না তার সবুজ সঙ্কেত আসেনি। আজও আইনশৃঙ্খলাজনিত কারণে দার্জিলিং মেল, পদাতিক-কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস-সহ প্রায় ২০টি ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে। মালদহের পর থেকে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না বলেই এই সমস্যা। কবে থেকে স্বাভাবিক হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।’’
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy