রেড রোডে দুর্গাপুজোর কার্নিভাল। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
বোধনের এক মাস আগে ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুজোর ঢাকে কাঠি দিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিসর্জনের শেষ দিন, শনিবার কলকাতার কার্নিভালের আসর কার্যত মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উৎসব হয়ে উঠল।
করোনাকালের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে দু’বছর বাদে কার্নিভালের ফিরে আসায় মুক্তির আমেজ ফুটে উঠেছে নাচ, গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আবেশে। বাংলার লোকনৃত্য, আদিবাসীদের নাচ থেকে রাজস্থান, গুজরাত, অন্ধ্রের নৃত্যকলাও মিশেছে কলকাতার পুজোর মোহনায়। কার্নিভালের পরিচিত মুখ শহরের নামজাদা পুজোর সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে অপেক্ষাকৃত অনামা পুজো বা অচেনা শিল্পীদেরও কাজ। বাঙালির দুর্গাদর্শনেরও বিচিত্র ব্যঞ্জনা। বাগুইআটির অর্জুনপুরের পুজোয় উৎসবের মেজাজ থেকে ঠাকুরপুকুর এসবি পার্কের পুজোয় পাড়ার বন্ধ হওয়া মিউজ়িয়মের দুঃখ লেগে থেকেছে শোভাযাত্রার গায়ে। আবার কিছুটা আনকোরা পুজো বরাহনগরের ন’পাড়া দাদাভাই সংঘের সিলিকন প্রতিমার নিটোল মাতৃমূর্তি সুন্দর খাপ খেয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা ‘মা গো তুমি সর্বজনীন’ গানের সঙ্গেই।
আলোয় ভাসা রেড রোডে বর্ণময় কার্নিভালের শুরু থেকে শেষ জুড়ে মুখ্যমন্ত্রীই। কলকাতার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পরে তার কৃতিত্ব দাবি করতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পর্যন্ত মাঠে নেমেছিলেন। উৎসবের শেষ দিনে কিন্তু দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরেই প্রচারের সবটুকু আলো। সাবেক বড় বাড়ির দালানের আদলে সাজানো হয় বিশিষ্টতম অতিথিদের মঞ্চ। সেখানে কেউ আসার বেশ খানিক ক্ষণ আগে থেকে রেড রোড জুড়ে মুখ্যমন্ত্রীরই লেখা ও সুর করা গান। কার্নিভাল শুরুর পরে অনেক পুজো কমিটির উপস্থাপনাতেও কার্যত ‘মমতা-বন্দনা’র প্রতিযোগিতা।
বিষয়টি নিয়ে স্বভাবতই খোঁচা দিতে ছাড়েনি বিরোধী দলগুলি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘স্বৈরাচারী শক্তি এ ভাবেই চলে। মাল নদীতে সরকারি অপদার্থতার জেরে উৎসবের মধ্যেই মানুষের প্রাণহানি হল। চাকরি-প্রার্থীদের ন্যায্য দাবিতে অবস্থান কার্নিভালের কারণ দেখিয়ে আড়াল করে রাখা হল। তার পরে যা হল, সেটা কোষাগারের অর্থে স্তাবকতার উদ্যাপন!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মতে, ‘‘পুরো পরিকল্পনাটাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চমক! উনি মোচ্ছব করছেন! আর রাজ্যের বাসিন্দাদের অন্য রাজ্যে চাকরি করতে গিয়ে দশেরা পালন করতে হচ্ছে।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও মন্তব্য, ‘‘এই কার্নিভাল রাজনৈতিক ইভেন্ট। শুধু মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য প্রতিমাকে নিয়ে গিয়ে কুচকাওয়াজ করানো হল!’’ তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় পাল্টা বলেন, ‘‘যে উৎসবে ইউনেস্কোর মতো সংস্থা স্বীকৃতি দিয়েছে, বাংলায় তা এগিয়ে নিয়ে যেতে যা করার রাজ্যের সরকার তা-ই করেছে। এটাকে ‘মমতা-শো’ বলে কটাক্ষ আসলে বাংলাকে পিছনে টানার চেষ্টা।’’ উত্তরবঙ্গের ঘটনা প্রসঙ্গেও সুখেন্দুশেখর বলেন, ‘‘কুম্ভমেলায় কেউ পদপিষ্ট হলে তো কুম্ভ বন্ধ করা হয় না!’’
শহরের বড়, ছোট পুজো কমিটিগুলির কাছে অবশ্য এ সব তর্ক অবান্তর। বরং শোভাযাত্রায় ট্যাবলোর গায়ে প্রকাণ্ড হরফে লেখা দেখা গিয়েছে, ইউনেস্কোর ঐতিহ্য-তালিকায় স্থান করে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। একাধিক পুজো কমিটির ট্যাবলোয় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি। দশভুজা মুখ্যমন্ত্রীর পোস্টারও চোখে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর লেখা দু’-তিনটি গানের সঙ্গে অনুষ্ঠান করেন অনেকেই। টালা প্রত্যয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে একটি একতারা ও দোতারা তুলে দেওয়া হয়। তার একটিতে লেখা ‘দিদি’, অন্যটিতে ‘মাতৃমা’। হিন্দুস্তান পার্কের পুজোয় আবার একটি ছোট্ট মেয়ে নীল পাড়, সাদা শাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেজে ঘুরছে। ইউনেস্কোর লোগো-ধারী এক জন খুদে ‘ভদ্রলোক’ তার পাশে।
কলকাতার দুর্গাপুজোয় বিভিন্ন প্রান্তিক শ্রেণি-সহ নানা ধর্মের মানুষজনকে সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টাকে স্বীকৃতির কথা বলেছিল ইউনেস্কো। রাজনৈতিক নেতাদের একাংশেরই অভিযোগ, আদতে কিন্তু পুজোর রাজনৈতিক চরিত্রটিই দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। কার্নিভালের আসরেও সেটাই দেখা গিয়েছে। এ দিনই শ্রীভূমির সুজিত বসু, সুরুচি সংঘের অরূপ বিশ্বাস, চেতলা অগ্রণীর ফিরহাদ হাকিমের মতো মন্ত্রীদের শোভাযাত্রায় হাঁটতে দেখা যায়। কলকাতার বারোয়ারি পুজোর মঞ্চ ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের মঞ্চ অবশ্য পুজোর রাজনীতিকরণের অভিযোগ মানতে চায়নি। বরং পুজোর পৃষ্ঠপোষকতায় মুখ্যমন্ত্রীর সক্রিয় ভূমিকা এবং বিভিন্ন পুজোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্কেরই প্রতিফলন কার্নিভালে দেখা গিয়েছে বলে দাবি। এ-ও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতারা যদি পুজোর কর্মকর্তা হন, তা হলে তো তাঁরা শোভাযাত্রায় হাঁটবেনই। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই অবান্তর।
৯৫টি পুজোর শোভাযাত্রা কখন শেষ হবে, তা নিয়ে প্রশাসনের ভিতরেই দুশ্চিন্তা ছিল। ঠিক ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তিন মিনিটের বেশি কেউ থামবেন না। কিন্তু সৌহার্দ বিনিময়ের পালা বার বারই দীর্ঘায়িত হয়েছে। বাগুইআটির দক্ষিণপাড়ার পুজোর ‘মুখ’ স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চকিতে দেখা করে যান। বালিগঞ্জ কালচারালের সঙ্গে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়েছেন মমতা। চকলেট দিয়েছেন ছোটদের, মহিলা ঢাকিদের সঙ্গে গল্প করেছেন, কথা বলেছেন। মঞ্চ থেকে নেমে করতাল বাজিয়েছেন, ডান্ডিয়ায় মেতেছেন, আদিবাসী শিল্পীদের সঙ্গে নেচেছেন। দেখা গিয়েছে কলকাতা পুলিশের সিপি এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি বিভোর হয়ে সে-ছবি মোবাইলে তুলছেন। তবে ইউনেস্কো স্বীকৃতির আবহেও বিদেশি অতিথি ছিলেন গুটিকয়েক। ‘ফরেন ডেলিগেট’ লেখা ঘেরাটোপগুলিতে স্থানীয় জনতাকেই বসতে দেখা গিয়েছে। সব কিছু মিটেছে নির্বিঘ্নে। তবে বিকেলে শুরু হওয়া কার্নিভাল শেষ হতে রাত ৯টা বেজে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy