গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লড়াই বেধেছে সমাজমাধ্যমে। লড়াই বেধেছে পুলিশ বনাম আমজনতার। ট্রিগার জনতার হাতে। চাঁদমারি পুলিশ। বাহিনীকে লক্ষ্য করে লেখা হচ্ছে, ‘‘পুলিশ তুমি যতই মারো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়।’’ আরজি কর-কাণ্ডে জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযানের আন্দোলন থেকে স্লোগান উঠেছে, ‘‘পুলিশ চটি চাটলে এত, মাইনে তোমার বাড়ল কত?’’ সেই স্লোগানও লিখিত আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে।
বস্তুত, আরজি কর-কাণ্ডের শুরু থেকেই সমাজমাধ্যমে অনবরত দোষারোপ করা হচ্ছে পুলিশকে। প্রথমে মূলত কলকাতা পুলিশ। পরে রাজ্য পুলিশও। সেই সব স্লোগান দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা সমাজমাধ্যমের পরিসর জুড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম দিকে খানিকটা হকচকিয়েই গিয়েছিল পুলিশ। তার পরে তারাও পাল্টা প্রচার শুরু করে। পুলিশের উপরমহল মনে করে, সাম্প্রতিক ‘সাইবার লড়াই’য়ে পুলিশ সবচেয়ে ‘সফল’ হয়েছে ‘পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ’-এর ডাকা ‘নবান্ন চলো’ কর্মসূচিতে। কারণ, আন্দোলনকারীদের ছোড়া ইটের ঘায়ে রক্তাপ্লুত সার্জেন্ট বা পুলিশকে তাড়া করে মারধর করার ছবি দ্রুত সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন পরিসরে ছড়িয়ে দিয়ে পাল্টা ‘আখ্যান’ তৈরি করা গিয়েছিল।।
কিন্তু একই সঙ্গে বাহিনীর মধ্যে এই আলোচনাও চলছে যে, এই ‘লড়াই’ শুরু করতে কি একটু বিলম্ব হয়ে গেল? গত সপ্তাহ থেকে পুলিশের পদস্থ আধিকারিক এবং কর্মীরা নিজেদের ফেসবুকে লিখতে শুরু করেছেন, ‘‘পুলিশের মেয়ের চিন্তা ছাড়ো, সে লড়াই করেই হচ্ছে বড়।’’ পাশাপাশিই মাঝারি স্তরের পুলিশকর্মীরা ফেসবুকে লিখতে শুরু করেন, কী ভাবে পরিচিতরা তাঁদের কাছে বিভিন্ন সময়ে সাহায্য চেয়েছেন এবং নানা ‘উপকার’ পেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে বড় ম্যাচের টিকিট থেকে শুরু করে নামী শিল্পীর কনসার্টের ‘পাস’ পাওয়ার তদ্বির বা রাস্তায় নিয়ম ভেঙে ট্র্যাফিক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ঘটনা। পুলিশের পাশাপাশি সিভিক ভলান্টিয়ারেরাও লিখতে শুরু করেন, ‘‘হচ্ছে বড় ছেলেও তোমার, তার দায়ও কি পুলিশের একার?’’
কিন্তু তাতে হালে পানি বিশেষ মিলছে না। কলকাতার এক নামী স্কুলের ছাত্রী তার ক্লাসের বন্ধুকে ‘নোট’ দিতে গিয়ে বেঁকে বসেছে। সটান বলেছে, ‘‘ওর বাবা পুলিশ! ওকে নোট দেব না।’’ অভিভাবক হিতোপদেশ দিতে গেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জবাব দিয়েছে, ‘‘এখন দেব না।’’
ঘটনার কথা শুনে কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ আধিকারিক একান্ত আলোচনায় মেনে নিয়েছেন যে, তাঁরা যদি প্রথম থেকেই সমাজমাধ্যমকে আগ্রাসী ভাবে ব্যবহার করতেন, তা হলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না। তাঁর কথায়, ‘‘১৪ অগস্ট মেয়েদের রাত দখলের ডাক উঠেছিল সমাজমাধ্যমেই। আমাদের তখনই সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এখন পুলিশের সঙ্গেই পুলিশের পোস্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।’’
সে উদাহরণ হাতের কাছেই মজুত। দিন কয়েক আগে একটি পুরনো পোস্টকে ‘ফেক’ বা ‘জাল’ বলে চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে পুলিশ। বছরখানেক আগে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা ট্র্যাফিক পুলিশের টাকা নেওয়ার একটি ছবি আবার উঠে এসেছিল। সেটিকে ‘জাল’ আখ্যা দিতে গিয়ে পুলিশ একটি ‘চালান নম্বর’ দিয়ে দাবি করে, নিয়ম মেনে ট্রাকচালকের থেকে ফাইন নিচ্ছিলেন পুলিশকর্মী। সেই ছবিতে ঘটনার তারিখও দেওয়া ছিল। অথচ ছবিটি এক বছর আগের। রে-রে করে ওঠে সমাজমাধ্যম। নতুন প্রশ্ন তোলা শুরু হয়, ‘‘যে পুলিশ নিজের ভাবমূর্তি ভাল করার জন্য জাল চালান তৈরি করে পোস্ট করছে, তারা আরজি কর-কাণ্ডেও তথ্য লোপাট করেনি তো?’’ বেকায়দায় পড়ে কলকাতা পুলিশকে সেই পোস্টটি শেষ পর্যন্ত মুছে দিতে হয়।
অগস্টের ৯ তারিখে আরজি করের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার আগে কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণদিবস, অলিম্পিক্সে ভারতীয় হকি দলের ব্রোঞ্জ জয়কে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। এমনকি, ৯ অগস্টও নীরজ চোপড়ার রুপো জয়কে ‘ভরসা বর্শায়’ বলে পোস্ট করা হয়েছে। তাতে তখন কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু আরজি করের ঘটনার পর থেকে দ্রুত ছবি পাল্টাতে থাকে। তখন আবার কলকাতা পুলিশ শুরু করে তদন্তের গতিপ্রকৃতি জানানো। সঙ্গে লম্বা লম্বা লেখা, ‘‘ন্যায়বিচার হবেই। দ্রুতই হবে। না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না। ভরসা রাখুন।’’ ইত্যাদি।
কিন্তু সমস্ত ছবি বদলে যায় ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে।
সেই রাতে বিনা বাধায় আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দুষ্কৃতীরা ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। সেই থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তুঙ্গে পৌঁছয়। তা আরও বাড়ে যখন পুলিশ ফেসবুকে দুষ্কৃতীদের ছবি প্রকাশ করে সাহায্য চায় জনতার। শুরু হয় কটাক্ষ ধেয়ে আসা। ১৯ অগস্ট রাখিপূর্ণিমার দিন পুলিশ রাখিবন্ধনের ছবি দিলেও কমেন্টে আছড়ে পড়ে মানুষের ক্রোধ।
তার পর থেকে ‘ভাবমূর্তি’ উদ্ধারে নেমেছে পুলিশ। বাবুঘাটের কাছে গঙ্গায় ভেসে যাওয়া মহিলাকে উদ্ধারের ভিডিয়ো, মহিলাকে লক্ষ্য করে অশালীন মন্তব্য করায় যুবককে গ্রেফতার মতো ঘটনা পোস্ট করা হয় ফেসবুকে। ‘নবান্ন চলো’ অভিযানের দিন উর্দিধারী এক মহিলা পুলিশের একটি সারমেয় শাবককে বিস্কুট খাওয়ানোর ছবি (সেটি তুলেছিলেন এক চিত্রসাংবাদিক) পোস্ট করা হয়। গত রবিবার পুলিশ দিবসে একটি পোস্টে বলা হয়েছে, পুলিশ শুধু মেয়ের পিতাই নয়, জননীও। এক সিভিক ভলান্টিয়ার পথদুর্ঘটনায় জখম এক ব্যক্তিকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন বলে যখন পোস্ট করা হয়, তখন দ্রুত তার সঙ্গে আরজি করের ঘটনায় ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারকে জুড়ে প্রশ্ন তোলা হতে থাকে যে, সিভিক ভলান্টিয়ারেরা আসলে কত ‘মহৎ’, সেই প্রচারই কি করা হচ্ছে? কারণ, তখন পুলিশের প্রতি সিংহভাগ মানুষ বিরূপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy