যে দিন পুজো মণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, সে দিন ধারে-কাছেও দেখা মেলেনি পুজো কমিটির প্রায় কারও। বিতর্কও হয়েছিল তা নিয়ে। নদিয়ার কল্যাণী আইটিআই মোড়ের সেই লুমিনাস ক্লাবের পুজো কমিটি এ বার রাজভবনের পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করল। পুরস্কার বাবদ তাদের পুজোর জন্য বরাদ্দ ওই এক লক্ষ ২৫ হাজার টাকা ১০০ দিনের কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের দেওয়া হোক বলে জানিয়ে দিলেন ক্লাব কর্তারা। ঘটনাচক্রে, পুজোর ঠিক আগেই কেন্দ্রের কাছ থেকে ১০০ দিনের প্রকল্পের ‘বকেয়া’ আদায়ে রাজভবনে ধর্নায় বসেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ দিন ধর্নার পর তৃণমূল সাংসদ অভিষেকের সঙ্গে রাজ্যপালের বৈঠকও হয়। এর পরে দিল্লি গিয়ে বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে রাজ্যপাল বৈঠকও করেছেন বলে রাজভবন সূত্রে খবর। রাজ্যপাল বোসের ওই তৎপরতায় ‘খুশি’ও হয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ১০০ দিনের প্রকল্প নিয়ে সেই বিতর্ক আবার রাজনৈতিক আলোচনায় উঠে এল এই ঘটনায়।
লুমিনাস ক্লাবের পুজোটি কল্যাণী শহর তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি অরূপ মুখোপাধ্যায় ওরফে টিঙ্কুর পুজো বলেই পরিচিত। পুজো কমিটির সভাপতি কল্যাণীর উপ-পুরপ্রধান তথা তৃণমূলের রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা কমিটির সম্পাদক বলরাম মাঝি। এ ছাড়াও শাসক তৃণমূলের অনেকেই এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত। গত ২১ অক্টোবর, সপ্তমীতে কল্যাণীর এই পুজো পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল বোস। সেই সময় পুজো কমিটির কাউকেই সেখানে দেখা যায়নি। স্থানীয় থানার পুলিশ থাকলেও দেখা মেলেনি পুলিশ সুপার বা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনও অফিসারের। যদিও কাছেই বুদ্ধপার্কে রানাঘাট পুলিশ জেলার সুপারের দফতর। সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসেননি কল্যাণীর মহকুমাশাসক বা পুরপ্রধানও। তাতেই প্রশ্ন উঠেছিল, রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের সংঘাতের জেরেই শাসকদলের নেতা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের এই অনুপস্থিতি? সেই জল্পনাই আরও জোরালো হল রাজভবনের পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের ঘটনায়।
ননবান্নও এ বছর রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন পুজোকে বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান দিয়েছে। সেই তালিকাতেও রয়েছে লুমিনাস ক্লাবের পুজো। নদিয়ার জেলাশাসক অরুণ প্রসাদ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সেই পুরস্কার তুলে দিয়েছেন ক্লাব কর্তৃপক্ষের হাতে। রাজ্য সরকারের পুরস্কার গ্রহণ করলেও রাজভবনের পুরস্কার নিলেন না ক্লাব কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের দুঃস্থ মানুষেরা ১০০ দিনের কাজ করে টাকা পাচ্ছেন না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই পুরস্কার নেওয়া উচিত নয়। ক্লাবের এক কর্তা রাজা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুরস্কারের অর্থে অন্তত কিছু মানুষের ১০০ দিনের মজুরি মিটিয়ে দেওয়া হোক।’’ আর এক ক্লাব কর্তার কথায়, ‘‘গত কয়েক বছর ধরে নানা ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। উল্টে রাজ্যের পুজো নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও প্রতিনিধির হাত থেকে আমরা পুরস্কার নিতে চাই না।’’
এর পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও সরকারি চাপ রয়েছে বলে দাবি করছে বিজেপির। রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার বলেন, ‘‘এত বড় পুজো রাজ্য সরকার বিরোধিতা করলে আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই হয়তো ক্লাবকর্তারা পুজোর স্বার্থে নতিস্বীকার করছেন। তৃণমূলের নেতারা ক্লাবের মধ্যে ঢুকে পুজো নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছেন। এর তীব্র নিন্দা করছি।’’
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে ২০১৩ সাল থেকে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কলকাতার সেরা শারোদৎসবগুলিকে পুরস্কৃত করা শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অন্য দিকে, বাংলার রাজভবনে আসার পর এটাই ছিল রাজ্যপাল বোসের প্রথম শারদোৎসব। এ বছরের প্রথম দিকেই স্বরস্বতী পুজোয় মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁর বাংলাভাষা শেখায় হাতেখড়ি হয়েছিল। শারদোৎসব শুরুর আগেই কলকাতা তথা শহরতলির শ্রেষ্ঠ পুজোগুলিকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা করেছিল রাজভবন। মঙ্গলবার, বিজয় দশমীর দিন রাজভবন থেকে তাদের বিচারে শ্রেষ্ঠ পুজোর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। পুরস্কার বাবদ ওই পুজো কমিটিগুলিকে রাজভবনের তরফে দেওয়া হবে এক লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। কেন রাজভবন ওই পুজোটিকে পুরস্কারের জন্য বিবেচিত করেছে, রাজভবনের তরফে তার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ বার রাজভবন এবং রাজ্য সরকারের বিচারে সেরার শিরোপা পেয়েছে উত্তর কলকাতার ‘টালা প্রত্যয়’। দুই প্রতিষ্ঠানের তৈরি সেরার তালিকায় লুমিনাস ক্লাবের পুজোটিও ছিল।
এই পুজো এ বার ৩১ বছরে পা দিয়েছে। চিনের বিলাসবহুল হোটেল ‘গ্র্যান্ড লিসবোয়া’র আদলে তৈরি হয়েছে তাদের মণ্ডপ। তা দেখতেই কাতারে কাতারে মানুষ কল্যাণীমুখী হয়েছেন পুজোর ক’দিন। সেই জনস্রোতে লাগাম টানতে প্রায় বেনজির ঘটনা ঘটাতে হয়েছে রেলকে। স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত কোনও ট্রেন দাঁড় করানো হয়নি কল্যাণী ঘোষপাড়া স্টেশনে। সেই পুজোই আবার বিতর্কে জড়াল। গত বছরেও পুজোমণ্ডপের কারুকার্যে তাক লাগিয়েছিল লুমিনাস ক্লাব। মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারের আদলে তাঁদের মণ্ডপসজ্জা দেখতে সে বারও বহু মানুষ কলকাতা থেকে কল্যাণী ছুটে গিয়েছিলেন। অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে, শর্ট সার্কিট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল মণ্ডপে। বন্ধ করে দিতে হয়েছিল মণ্ডপের বিশেষ আলোর প্রদর্শনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy