বিচারপ্রার্থী, চাকরিপ্রার্থী-সহ এজলাসে আসা সাধারণ মানুষদের ‘সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া’ বলতে শোনা যায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
শুধু মামলা করতে নয়! অনেকে আদালতে মামলা শুনতেও আসেন। কেউ আসেন কোর্টের বিচারপ্রক্রিয়া চাক্ষুষ করতে। আবার সেই বিচারপতি যদি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় হন, তবে তাঁকে দেখতেও আদালতে আসেন অনেকে। আর তাঁদের নিয়ে বিশেষ সতর্ক বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ছবিতে শাহরুখ খানের মুখে সাধারণ মানুষের ক্ষমতা নিয়ে বিখ্যাত সংলাপ তো সবার জানা। বাদশার মুখে শোনা গিয়েছিল, ‘‘ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ আ কমন ম্যান’ (সাধারণ মানুষের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখবেন না)। কলকাতা হাই কোর্টে যিনি এখন ‘বাদশা’ হিসাবে অনেকের কাছে পরিচিত সেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়েরও সাধারণ মানুষ সম্পর্কে একটা সংলাপ বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। সাধারণ গরিবগুর্বো মানুষকে তিনি বলেন, ‘সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া’। ইদানীং অনেক বার এই সংলাপ শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে। বিভিন্ন মামলায় তাঁর অনেক পর্যবেক্ষণের মতো এই সংলাপও আদালতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
এখন তো প্রায় প্রতিদিনই স্কুলের নিয়োগ দুর্নীতি মামলা নিয়ে সরগরম থাকে হাই কোর্ট। এই মামলাগুলির শুনানির সময় বিচারপতিদের এজলাসে ভিড় অনেকটাই বেশি থাকে। বিচারপ্রার্থী, চাকরিপ্রার্থী-সহ এজলাসে আসা এই সাধারণ মানুষদের ‘সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া’ বলতে শোনা যায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে। এঁদের প্রতি কোনও দুর্ব্যবহার দেখলেই গর্জে উঠেন তিনি। বিচারপতির ক্ষোভ থেকে রেহাই পান না হাই কোর্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীরা তো বটেই, আইনজীবীরাও। তাঁদের উদ্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য শোনা যায়, ‘‘ওঁরা সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া। সংবিধান ওঁদের প্রতি দায়বদ্ধ। যা বলার ভদ্র ভাবে সম্মান দিয়ে বলবেন।’’
এই তো কয়েক দিন আগের ঘটনা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে স্কুলের নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানি। কারও চাকরি বাতিল হবে কি না, তা নিয়ে এজলাসের বাইরে নানা জনের মুখে চলছে জোর আলোচনা। একটু পরেই এজলাসে ঢুকলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তড়িঘড়ি কোর্টের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছেন চাকরিপ্রার্থী-সহ অন্যরাও। তাঁদের উপর নজরদারি করতে হিমশিম অবস্থা পুলিশের। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাগ, জলের বোতল বাইরে রাখতে হয়। মোবাইল ফোনের সুইচ অফ কি না, নিশ্চিত করতে হয়। এই অবস্থায় এত জনকে সামাল দিতে গিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন এক পুলিশকর্মী। এজলাসের ভিতর থেকে তা শুনতে পান বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। হঠাৎ তিনি কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের ডেকে পাঠান এজলাসের ভিতরে। তাঁরা এলে বিচারপতি প্রশ্ন, ‘‘বাইরে এত কেন চিৎকার? কার উপর চিৎকার করছেন?’’ পুলিশকর্মী জানান, অনেকে কথা না শুনে জোর করে এজলাসের ভিতরে প্রবেশ করতে চাইছেন। শুনে পাল্টা বিচারপতি বলেন, ‘‘কেন এমন ব্যবহার করছেন? ওঁরা সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া। ওঁদের অনুরোধ করুন। হাতজোড় করে বলুন। এ ভাবে ওঁদের মেজাজ দেখাবেন না। বুঝিয়ে বলুন, দেখবেন ওঁরা শুনবেন।’’
সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনায় বিচারপতির ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন এক আইনজীবী। সে বারও শুনানি চলাকালীন এজলাসে প্রচুর ভিড়। এত মানুষ এসে যান যে, দরজা খুলে ঢোকা যাচ্ছে না। কোর্টের শুনানিতে অংশ নেবেন ওই আইনজীবী। দরজা খুলতে না পেরে বেজায় রেগে যান তিনি। তাঁকে বলতে শোনা যায়,‘‘এখান থেকে আপনারা সরে যান। দরজা খুলতে পারছি না। এটা কিন্তু ভাল হচ্ছে না!’’ ওই আইনজীবীর কথা কানে যেতেই শুনানি থামিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কে এমন বললেন? কে? তাঁকে আমি দেখতে চাই।’’ এর পরে ‘খারাপ’ ব্যবহার যে করা হয়েছে তা ওই আইনজীবী স্বীকার করেন। তাঁকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সকলের সামনেই বলেন, ‘‘ওঁদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করবেন না। ওঁরা সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া। ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন।’’ নির্দেশ মেনে ওই আইনজীবী বলেন, ‘‘দুঃখিত ধর্মাবতার! এমনটা আর হবে না।’’
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে সাধারণত প্রাথমিক স্কুল এবং নিয়োগ দুর্নীতির কয়েকটি মামলার শুনানি হয়। হাই কোর্টে বিচারপতিদের তালিকা অনুযায়ী, কোনও বেঞ্চ নির্ধারিত মামলা ছাড়া অন্য মামলা শুনতে পারে না। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৭ নম্বর কোর্টের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। কিন্তু এই কোর্টে মামলা না থাকলেও অনেক বিচারপ্রার্থী গিয়ে হাতজড়ো করে দাঁড়িয়ে থাকেন। দৃষ্টি পড়লে তাঁদের উদ্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রায়ই বলেন, ‘‘আপনারা তো সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া। দয়া করে এ ভাবে হাতজোড় করবেন না। আপনাদের জন্যই তো এত কিছু। আপনাদের জন্যই সংবিধান রচনা হয়েছে। কিছু বলার থাকলে হাত তুলে বলুন।’’
মামলা না থাকলেও তাঁর এজলাসে চলে আসা ‘সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া’-দের কিছু না কিছু একটি ব্যবস্থা করে দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। মাস খানেক আগেই, পূর্ব মেদিনীপুরের এক বিচারপ্রার্থীর আকুতি শুনে এজলাসে বসেই জেলার বিচারককে ফোন করেছিলেন তিনি। আবার আর এক মহিলা জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী সন্তানের চিকিৎসার খরচ দিচ্ছেন না। উল্টে মামলা করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে। বীরভূমের ওই মহিলার দাবি শুনে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের দাওয়াই, ‘‘জেলা বিচারককে গিয়ে আমার নাম বলবেন। আশা করি কাজ হয়ে যাবে।’’
এই সব নাগরিককে সাহায্য করতে তিনি এতটাই তৎপর যে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় রাজ্যের সব নিম্ন আদালতের মুখ্য বা প্রধান বিচারকের ফোন নম্বর নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। এবং এজলাসেও সেই ডায়েরি সঙ্গে রাখেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy