আরজি কর-কাণ্ডে বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূূচি। —নিজস্ব চিত্র।
আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার ফের কলকাতার রাস্তায় নামলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কলেজ স্ক্যোয়ার থেকে মিছিল করলেন ধর্মতলা পর্যন্ত। মিছিল শেষে সভা। অতীতের কর্মসূচিগুলির মতো বুধেও জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে পা মেলালেন সিনিয়র ডাক্তারেরা। মিছিলে শামিল হল নাগরিক সমাজও। কেন ফের পূর্ণ কর্মবিরতি, সেই ব্যাখ্যাও দেওয়া হল ধর্মতলার সভা থেকে। একই সঙ্গে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল, আন্দোলনের অভিমুখ একমাত্র রাজ্য সরকার নয়। সমান ভাবে সিবিআইও। প্রয়োজনে দিল্লিতে গিয়ে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও এল। ডাক্তারেরা যে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও পক্ষ নয়, সেই বার্তাও এল। মানুষের কথা বিবেচনা করে কর্মবিরতি ছাড়া আন্দোলনে অন্য কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করা যায় কি না, ধর্মতলার সভায় তা নিয়েও প্রস্তাব গেল জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে। আন্দোলনকে যে রাজনীতিকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অভিপ্রায়ে ব্যবহার করতে চাইছেন, সে কথাও উঠে এল।
আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দেবাশিস হালদারের দাবি, সরকার পক্ষের একাংশ বোঝাতে চাইছে জুনিয়র ডাক্তারেরা নাকি ‘গণশত্রু’। মানুষের কথা না ভেবেই কর্মবিরতি চালানো হচ্ছে, এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে দাবি দেবাশিসের। তিনি বলেন, “কোনও রোগীর মৃত্যু তাঁর পরিবারকে যতটা দুঃখ দেয়, এক জন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীকেও ততটাই দুঃখ দেয়। আমরা কেন আবার কর্মবিরতিতে ফিরতে বাধ্য হলাম জানেন? আমরা একটি সদিচ্ছা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেই সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না রাজ্য সরকার। তারা খেলিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরা এক পক্ষ। রোগীরা অন্য পক্ষ। কিন্তু আমরা বলতে চাই, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী-রোগী-পরিজন সবাই এক পক্ষে। উল্টো পক্ষে যদি কেউ থাকে, সেটি রাজ্য সরকার।”
কর্মবিরতির কারণে জুনিয়র ডাক্তারদের যে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সে কথাও উঠে আসে দেবাশিসের গলায়। রোগী মৃত্যুর দায় কি শুধুই সরকারের? জুনিয়র ডাক্তারদের নয়? এই ধরনের প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে তাঁদের। ধর্মতলার সভা থেকে দেবাশিস জানান, তাঁরা কাজে ফিরতে চান। কিন্তু স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে অপসারণ করতে হবে এবং তাঁদের দাবিদাওয়াগুলি সরকারকে মেনে নিতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা গণশত্রু নই। আমরা কর্মবিরতি তুলতে চাই। এখনই তুলতে চাই। কিন্তু দাবিগুলি না মানা হলে কোন ভরসায় তুলব? এই জায়গা থেকে আমরা কী ভাবে সুরক্ষিত বোধ করব? তবে আমরা প্রমাণ করব, ডাক্তার-রোগী সবাই এক পক্ষ। উল্টো দিকে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা পক্ষ বাছুন। তাঁরা এই সভার পক্ষে আসবেন না কি উল্টোপক্ষে থেকে আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে চাইবেন। আমরা সময় দিচ্ছি। প্রতিটি ঘণ্টার হিসাব আমরা নেব।”
সিবিআইয়ের উদ্দেশেও বার্তা ভেসে এল জুনিয়র ডাক্তারদের সভামঞ্চ থেকে। তাঁদের আন্দোলনের অভিমুখ যে শুধুমাত্র রাজ্য সরকারের দিকে নয়, সিবিআইয়ের দিকেও, সেই বার্তা দিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। প্রশ্ন তুললেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবীদের ভূমিকা নিয়েও। শীর্ষ আদালতে ও নিম্ন আদালতে সিবিআইয়ের আইনজীবীদের ভূমিকায় ‘চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ দেখছেন তাঁরা। অতীতে সিবিআই যে মামলাগুলির তদন্তভার নিয়েছে সেগুলির মধ্যে কতগুলির শেষ পর্যন্ত মীমাংসা হয়েছে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের আশঙ্কা, আন্দোলনকে জিইয়ে রাখতে না পারলে ‘সেটিং’ হয়ে যেতে পারে। মঞ্চ থেকেই বার্তা এল, “আমরা এই সেটিং করতে দেব না। প্রয়োজন হলে আমরা দিল্লি যাব। আমরা একসঙ্গে আওয়াজ তুলব। আমাদের আন্দোলনের একমাত্র অভিমুখ রাজ্য সরকার নয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজ্য সরকার অবশ্য আন্দোলনের অভিমুখ। কিন্তু এই চাপ যেন সিবিআইও অনুভব করে।”
তবে দ্বিতীয় বার কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া নিয়ে বুধবার বার বার ব্যাখ্যা দিতে দেখা গেল জুনিয়র ডাক্তারদের। তাঁরা যে রোগীদের কথাও মাথায় রাখছেন, সেটিও বুঝিয়ে দেন। তাঁদের যুক্তি, যদি কর্মবিরতির পথ থেকে সরতেই হয়, তবে সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই সেই সিদ্ধান্ত নেবেন। কারও ‘নৈতিক জ্ঞান’ শুনে নয়।
নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে একেবারে শুরু থেকেই পাশে থাকতে দেখা গিয়েছে সিনিয়র ডাক্তারদের একাংশকে। বুধবার জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মসূচিতে ছিলেন সিনিয়র ডাক্তারদের একাধিক সংগঠনের মিলিত মঞ্চ ‘জয়েন্ট প্লাটফর্ম অব ডক্টরস্’-এর প্রতিনিধি পুণ্যব্রত গুণও। তিনি জানান, আন্দোলনে সিনিয়র ডাক্তারেরা শুরু থেকেই জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে রয়েছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রথম দফার কর্মবিরতির সময় প্রায় ৫০ দিন ধরে সিনিয়র ডাক্তারেরা অতিরিক্ত সময় কাজ করে গিয়েছেন। সরব হলেন হাসপাতালে ‘ভয়ের রাজনীতি’ নিয়েও। আগামী দিনেও জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পাশে থাকার বার্তা দিলেন তিনি। পুণ্যব্রত বলেন, “জুনিয়র ডাক্তারেরা কাজে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁরা আবার এই পদক্ষেপে বাধ্য হয়েছেন। আমরা আমাদের ভাই-বোনেদের এমন কোনও পরিস্থিতিতে কাজ করতে বলতে পারি না, যেখানে তাঁরা সুরক্ষিত বোধ করতে পারেন না।”
তবে একই সঙ্গে পুণ্যব্রতর অনুরোধ যাতে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে আন্দোলনের কর্মসূচি স্থির করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তিনি বলেন, “কর্মবিরতি ছাড়াও অন্য কর্মসূচি হতে পারে। অবস্থান, অনশন হতে পারে কিংবা জুনিয়র ডাক্তার-সিনিয়র ডাক্তার উভয়েরই কর্মবিরতি হতে পারে। মানুষ যাতে আমাদের সঙ্গে থাকেন, সেটিকে দেখে আপনারা সিদ্ধান্ত নেবেন।” জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বুধবারের মিছিলে হাঁটেন অভিনেত্রী সোহিনী সরকারও। মিছিল শেষে সভামঞ্চে বক্তৃতা করেন তিনি। সেখানেই সোহিনী জানান, তাঁরা বুঝতে পারছেন একাংশের রাজনীতিক এই আন্দোলনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, “আমরা বুঝতে পারছি, তাঁরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই আসছেন। সামনে ২০২৬ সাল। এই বিষয়টিকে ব্যবহার করে কোথাও পৌঁছতে পারলে তাঁদের জন্য সুবিধা হবে। সেটি সাধারণ নাগরিকেরাও বুঝতে পারছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy