অবস্থানমঞ্চে জুনিয়র ডাক্তারেরা। —ফাইল ছবি।
শুরু হয়েছিল ৯ অগস্ট। শেষ হল (আপাতত) ২০ সেপ্টেম্বর। এই ৪৩ দিনে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নানা বাঁক পেরিয়েছে। আরজি কর হাসপাতালের চত্বর, লালবাজারের অদূরে ফিয়ার্স লেন থেকে সেই আন্দোলন শেষে গিয়ে পড়েছিল সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবনের সামনের রাস্তায়। ১০ দিন ধরে চলেছে টানা অবস্থান। যা শুক্রবার দুপুর ৩টেয় শেষ হল।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের জেরে কলকাতার পুলিশ কমিশনার, ডিসি (নর্থ) এবং স্বাস্থ্য দফতরের ডিএমই, ডিএইচএস বদল করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। সে অর্থে আন্দোলনকারীদের ‘বড় মাপের জয়’ হয়েছে। কিন্তু তার আগে ৪৩ দিনের ইতিহাস দেখেছে অন্দরের টানাপড়েন, মতানৈক্য এবং দ্বন্দ্ব। যা শুরু হয়ে গিয়েছিল আন্দোলনের ১৫ দিনের মাথায়। বৃহস্পতিবারের জিবি (জেনারেল বডি) বৈঠকেও তা গড়িয়েছিল তীব্র টানাপড়েনে।
একাধিক সংগঠন বা দলের মঞ্চে বিভিন্ন মতামত থাকবেই। সেটাই দস্তুর। একাধিক রাজনৈতিক দল যখন কোনও ‘জোট’ বা ‘ফ্রন্ট’ গড়ে, সেখানেও মতানৈক্য থাকে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ বাম জমানাতেও থেকেছে। বড় শরিক সিপিএমের বিরুদ্ধে ছোট শরিক আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের ক্ষোভ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে বাংলায় ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। কিন্তু দেড় বছরের মধ্যেই মতানৈক্যের জেরে সেই জোট ভেঙে এবং মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল কংগ্রেস।
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে যে মতানৈক্য ছিল, তার ‘প্রমাণ’ হিসেবে অনেকেই বার বার দীর্ঘ সময় ধরে চলা জিবি বৈঠকের কথা বলছেন। সেই বৈঠকে যে মতানৈক্য বেধেছে, তা আন্দোলনকারীরা পরোক্ষে স্বীকারও করে নিয়েছিলেন। যখন তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘৩০ জন একটা বৈঠকে থাকলে ৩০ রকমের মতামত থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, আমরা সকলেই পাঁচ দফা দাবি নিয়ে একজোট হয়ে লড়ছি।’’
কার্যত আন্দোলন শুরুর সময় থেকেই জুনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশ কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। সূত্রের খবর, অগস্টের ২২-২৩ তারিখ নাগাদই কর্মবিরতিতে ইতি টানতে চেয়ে দাবি উঠে যায় বৈঠকে। ঘটনাচক্রে, তাঁরা একটি বামপন্থী দলের ছাত্র সংগঠনের অঙ্গ। কিন্তু অন্য অংশ আবার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ‘একরোখা’ ছিলেন। জুনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশের বক্তব্য, রাজ্য সরকারের তরফে তখন থেকেই ‘সেতুবন্ধন’ করার চেষ্টা হচ্ছিল। জুনিয়র ডাক্তারদের যে অংশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন নবান্নের ‘দূতেরা’, তাঁরা কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে পিছিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁদের। তবে এ-ও ঠিক যে, তাঁরা আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে যাননি।
সরকারের তরফে যাঁরা আন্দোলনকারীদের ‘মধ্যপন্থী’ অংশের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন, তাঁদের নিয়েও প্রশ্ন থেকেছে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, শহরের দুই বিশিষ্ট চিকিৎসককে ‘মধ্যস্থতাকারী’ হতে অনুরোধ করা যায় কি না, তা নিয়ে সরকারি স্তরে একাধিক বার আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের কাছে আর যাওয়া হয়নি। ফলে সরকারের ‘সদিচ্ছা’ নিয়েও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়েছিল।
এমনিতে জুনিয়র ডাক্তারদের মঞ্চে একাধিক সংগঠনের প্রভাব রয়েছে। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে যে সংগঠনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সূত্রের খবর, কর্মবিরতি তুলে নিয়ে কাজে ফেরার পক্ষে তারাই বেশি সরব ছিল। অন্য দিকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ এবং এসএসকেএমের জুনিয়র ডাক্তারদের নেতৃত্বের বড় অংশ কর্মবিরতি জারি রাখার পক্ষে ছিলেন। সূত্রের দাবি, আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে অভ্যন্তরে মতানৈক্য ছিল। কিন্তু তা কখনওই প্রকাশ্যে আসেনি। সাংবাদিক সম্মেলনে অনিকেত মাহাতো, দেবাশিস হালদার, কিঞ্জল নন্দ, রুমেলিকা কুমার মুখোপাধ্যায়দের ‘স্বর’ আলাদা হলেও ‘সুর’ একই থেকেছে। কারও স্বর ‘কড়া’ আবার কারও ‘নরম’ হলেও দাবি আদায়ের বিষয়ে ‘সুর’ ছিল এক। ফলে সামগ্রিক ভাবে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জনমানসে আন্দোলনকে ‘ঐক্যবদ্ধ’ রাখতে পেরেছেন তাঁরা।
শুক্রবার স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান তুলে নেওয়া নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। একটি অংশ ‘হতাশ’ বলেই খবর। একান্ত আলোচনায় অনেকে তা গোপনও করছেন না। কর্মস্থলে নিরাপত্তা এবং সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে ‘হুমকি সংস্কৃতি’ (থ্রেট কালচার) শেষ পর্যন্ত নির্মূল না হলে আবার নতুন উদ্যমে এই আন্দোলন শুরু করা যাবে কি না, তা নিয়েও দোলাচল কাজ করছে অনেকের মধ্যে। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের বড় অংশ মনে করছে, হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিকাঠামো গঠনের যে দাবি তাঁরা তুলেছিলেন, তা রাজ্য সরকার মেনে নিলেও ‘থ্রেট কালচার’ বন্ধ করা নিয়ে সে অর্থে কোনও ‘নিশ্চয়তা’ দেয়নি। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রায় সব অংশই কাজে ফেরার বিষয়ে ‘ইতিবাচক’ মনোভাবের কথা বলেছিলেন। কিন্তু একটি বড় অংশ চেয়েছিল, রাজ্য সরকারের থেকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত এবং ‘থ্রেট কালচার’ বন্ধ করার বিষয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত না করেই অবস্থান তুলে নিতে হচ্ছে বলে মত একটি অংশের। তাঁদের আরও বক্তব্য, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বদল বা স্বাস্থ্য দফতরের দুই শীর্ষকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জনমানসে ‘জয়োল্লাস’ তৈরি করলেও কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত দাবিটিই মৌলিক। সেটিই এখনও পুরোপুরি মেটেনি, বিশেষত ‘থ্রেট কালচার’ সংক্রান্ত বিষয়ে। যা অনেকের কাছেই হতাশার। তবে প্রকাশ্যে ‘ঐক্য’ই দেখাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। জানিয়ে রাখছেন নতুন আন্দোলনের কথাও।
জুনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশ মনে করছে, এক বার অবস্থান উঠে গেলে নতুন করে তা গড়ে তোলা মুশকিল। তখন সরকার আবার নিজের ‘মূর্তি’ ধারণ করতে পারে। ভবিষ্যতে আবার আন্দোলন শুরু করতে হলে তা যাতে ‘ঐক্যবদ্ধ’ ভাবে হয়, সে কথাও মাথায় রাখার কথা বলছেন কেউ কেউ। জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকের এ-ও বক্তব্য যে, থ্রেট কালচারের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে মেডিক্যাল কলেজগুলির অন্দরে ‘ঘুঘুর বাসা’। যা আসলে আর্থিক অনিয়মের চক্র। তা নির্মূল না করা গেলে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের ভবিষ্যতে নানা ভাবে ‘বিপন্ন’ করা হতে পারে। সেই কারণেই আরও ‘চাপ’ তৈরি করে রাজ্য সরকারের থেকে সেই সংক্রান্ত দাবি আদায়ের পক্ষপাতী ছিলেন অনেকে। প্রসঙ্গত, জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিটি জিবিতেই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং তুলে নেওয়া নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার যে জিবি বৈঠকে আপাতত আংশিক কর্মবিরতি প্রত্যাহারের (শনিবার থেকে জরুরি পরিষেবার কাজে ফিরবেন তাঁরা) সিদ্ধান্ত হয়, সেখানেও তীব্র তর্কবিতর্ক চলেছে বলেই খবর। বৃহস্পতিতে আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারেরা সংখ্যায় বেশি ছিলেন। অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলির জুনিয়র ডাক্তারেরা তত সংখ্যায় ছিলেন না। অনেকের বক্তব্য, বৃহস্পতিবারের জিবিতে ‘নরমপন্থী’ অংশ যে তাদের লোক বাড়িয়ে দেবে, তা তাঁরা ধরতে পারেননি। ফলে মতামতের ভারে তাদের পিছিয়ে থাকতে হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মত ভাবেই কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
তবে ‘নরমপন্থী’ অংশের দিক থেকেও যে যুক্তি আসছে তা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ওই অংশের মতে, সরকার যে পর্যন্ত দাবি মেনে নিয়েছে তা আন্দোলনের ‘বিরাট জয়’। যে কোনও আন্দোলনকেই কোথায় থামতে হবে, কোথায় এগোতে হবে, কোথায় খানিক পিছোতে হবে তা জানতে হয়। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ দাবিদাওয়া মিটে যাওয়ার পরও যদি সব দাবি আদায়ের ‘গোঁয়ার্তুমি’ করা হত, তা আখেরে ক্ষতি করত আন্দোলনেরই। আন্দোলনের যাঁরা সমর্থক, তাঁদেরও অনেকে মনে করেছেন, কালীঘাট বৈঠকে ‘সাফল্যের’ পর কর্মবিরতি থেকে সরে আসাটা উচিত ছিল। তা ছাড়া, সরকারি হাসপাতালের রোগীদের স্বার্থ দেখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
এই আন্দোলনে সিনিয়র ডাক্তারদের একটি বড় অংশ পাশে থেকেছে জুনিয়র ডাক্তারদের। সরাসরি সমর্থন এবং সাহায্যও করেছেন তাঁরা। জুনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশের বক্তব্য, সিনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশ চেয়েছিল, যাতে অন্তত পুজো পর্যন্ত কর্মবিরতি জারি থাকে। সেখানে যে ‘রাজনৈতিক স্বার্থ’ ছিল না, তা নয়।
জুনিয়র ডাক্তারদের একটি অংশকে ‘নরম’ এবং ‘কট্টর’ দু’দিকের চাপের মধ্যেই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়েছে বলে দাবি অনেকের। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ ১৫ দিনের মাথাতেই কর্মবিরতি তোলার পক্ষপাতী ছিল। অন্য অংশ ‘বাইরে’ থেকে প্রভাব খাটিয়ে পুজো পর্যন্ত কর্মবিরতি জারি রাখার বিষয়ে বার্তা দিয়েছিল। এ সবের মধ্যেই শুক্রবার শেষ হচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান। আংশিক কর্মবিরতিও উঠে যাচ্ছে শনিবার থেকে। কিন্তু কৌতূহল রয়ে যাচ্ছে যে, এই দফার শেষ থেকে কি নতুন শুরুর বীজ বোনা হবে? তেমন হলে সেই আন্দোলন কি এ বারের মতোই ‘ঐক্যবদ্ধ’ থাকবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy