সুরকার মদনমোহনের সঙ্গে লতা।
সে সব দিনের সম্রাজ্ঞী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর, যখন স্কুলে না গিয়ে আমি বাড়িতে রেডিয়ো নিয়ে পড়ে থাকতাম সারা দিন। ষাটের দশক তখন। কত যে গান দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলেন আমার জীবনকে তিনি!
‘সীমা’ ছবিতে শঙ্কর-জয়কিষণের সুরে গাওয়া লতাজির ‘মনমোহন বড়ি ঝুটে/ হার কে হার নহি মানে’— এই গানটি খুব মনে পড়ে। জয়জয়ন্তী রাগে বাঁধা এই গানে রাগটির বাগেশ্রী অঙ্গ বিশেষ ভাবে প্রকাশ পেয়েছে— ‘হার কে হার নাহি মানে’— এই অংশটি শুনলেই বোঝা যায়। জয়জয়ন্তী রাগ দেশ অঙ্গেও গাওয়ার প্রচলন আছে। মান্না দে-র কণ্ঠে মদনমোহন সুরারোপিত এই জয়জয়ন্তী রাগেই তৈরি ‘দেখ কবীরা রোয়া’ ছবিতে ‘বৈরন হো গয়ি রয়না’ গানটিতে ‘রয়না’ শব্দটির উপর গায়কের সুরবিস্তার শুনলে দেশ অঙ্গ স্পষ্ট হয়। সেই সময়ে এমন সব সুরকার উপস্থিত হয়েছিলেন আমাদের দেশে যে, লতাজির মতো গায়িকা বিভিন্ন গানের মধ্য দিয়ে তাঁর পুরো গায়নশক্তি নিষ্কাশন করে দিতে পেরেছিলেন। যেমন, ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’ ছবিতে বস্ন্ত দেশাইয়ের সুরে লতাজি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি দ্বৈতসঙ্গীত উপহার দিয়েছিলেন মালগুঞ্জি রাগে। গানটি ছিল— ‘নৈন সে নৈন নহি মিলাও’। ওই একই রাগের ব্যবহার ছিল আর ডি বর্মণের প্রথম ছবি ‘ছোটে নবাব’-এর একটি গানে লতাজির কণ্ঠে। গানটির প্রথম লাইন— ‘ঘর আ যা ঘির আয়ি বদ্রা সাঁওরিয়া’। যদিও আজীবন সুর নিয়ে পরীক্ষাপ্রবণ রাহুলদেব বর্মণ ‘বদ্রা’ শব্দটিতে এসে মালগুঞ্জির মূল রূপ থেকে সামান্য সরে যান উক্ত শব্দে অন্য স্বরের মিশ্রণ ঘটিয়ে। ছবিতে গানটি এক নর্তকীর দ্বারা গীত হলেও একা বসে রেকর্ডটি শুনতে মন বিষাদাক্রান্ত হয়, যখন ‘ঘর আ যা’ আহ্বানটি ধ্বনিত হয় লতাজির সুরঋদ্ধ কণ্ঠে। একটি মেয়ে একাকিনী, তার পুরুষকে ঘরে ফিরে আসতে বলছে— এই আবহ জেগে ওঠে তখন।
লতাজির যে কোনও গানই তার অন্তর্লীন আবেগকে চিরদিনই বড় গভীর ও নির্ভুল ভাবে প্রকাশ করেছে। যেমন, ‘গুঞ্জ উঠি সেহনাই’ ছবিতে ‘তেরে সুর অউর মেরে গীত’ গানটিতে লতাজি যখন বলেন, ‘ম্যায় তেরা যোগন, তু মেরা মিত/দোনো মিল কর বনেগি প্রীত’, তখন বেহাগ তার পূর্ণমাধুর্যে বিকাশ পায় লতাজি ও বসন্ত দেশাইয়ের ষুগ্ম সাহচর্যে আর আমাদের যৌবন যেন জীবনে তখনও না-আসা সেই যোগিনীর প্রতি আকাঙ্ক্ষাধন্য হয়ে ওঠে। এই গানের পাশাপাশি মনে পড়ে ‘মেরা সায়া’ ছবিতে ‘তু যাঁহা যাঁহা চলেগা মেরা সায়া সাথ হোগা’। গানটিতে লতাজির কণ্ঠ ধারণ করেছিল নন্দ্ রাগকে। সে গানের সুরকার ছিলেন মদনমোহন। এই মদনমোহনের সুরেই লতাজি গেয়েছিলেন ‘যো হামনে দাস্তান আপনি শুনায়ে আপ কিঁউ রোয়ে, কিউ রোয়ে’। চারুকেশী রাগাশ্রিত এই গানটিতে যেমন লতাজি গানের অন্তর্লীন বিষাদ অভিব্যক্ত করেছিলেন, তেমনই ‘আপ কি কসম’ ছবিতে ‘চোরি চোরি ছুপকে ছুপকে’
গানটিতে লতাজির কণ্ঠ প্রকাশ করেছিল এক প্রেমে পড়া তরুণীর আনন্দচাঞ্চল্য। তিলং রাগে যে গান বেঁধেছিলেন আর ডি বর্মণ।
শচিনদেব বর্মণের সুরেও অজস্র স্মরণীয় গান আমরা লতাজির কণ্ঠে পেয়েছি। ‘গাইড’ ছবিতে খাম্বাজ রাগে ‘পিয়া তোসে নয়না লাগে রে’ গানটি বিশেষ ভাবে স্মরণীয় নানা কারণে। দু’একটি বলি। গানের দ্বিতীয় লাইনে ‘জানে ক্যায়া হো আব আগে রে’, এখানে পৌঁছে আমরা দেখি, ‘রে’ কোটেড শব্দটি যেমন বাণীতে রয়েছে, তেমনই সুরেও উপস্থিত হয় ঋষভই। সা-সা-রে। তা ছাড়া, এই গান রূপক তালে শুরু হয়, কিন্তু অন্তরায় চলে যায় দীপচন্দি তালে— সুরেরও সামান্য হেরফের ঘটে। আবার, মুখড়ায় ফিরে এসে রূপক তালটিই অবলম্বন করে। পুরো বিষয়টিই এত সহজ ও অনায়াসে সম্ভব করে তোলে লতাজির গায়ন যে, কোথাও কোনও অতিরিক্ত ঝাঁকুনি লাগে না। বরং এক নাট্যমুহূর্ত তৈরি হয়। নৌশাদের সুরেও অনেক অসামান্য গান লতাজির কাছে আমরা পেয়েছি। ‘মুঘল-ই আজ়ম’-এর কথা নতুন করে বলছি না। কিন্তু ‘উড়ন খটৌলা’ ছবিতে আবার ‘হামারে দিল সে না যানা/ ধোঁকা না খানা/ দুনিয়া বড়ে বেইমান’— বেহাগ-নির্ভর এই গানটির পিকচারাইজ়েশনের সময়ে অধুনাবিস্মৃত অভিনেত্রী নিম্মির শান্ত-বেদনাময় অশ্রুসমাহিত রূপটি লতাজির গায়নেও যেন ধরা পড়েছিল। সঙ্গীত পরিচালক জয়দেব লতাজিকে দিয়ে এমন কিছু গান রেকর্ড করিয়েছিলেন, যা ভোলা যায় না। ‘প্রেমপর্বত’ ছবিতে ‘ইয়ে নীর কাঁহাসে বর্ষে/ইয়ে বদরি কাঁহাসে আয়ি হ্যায়’ গানটি তিলক কামোদ রাগে বেঁধেছিলেন সুরকার। জয়দেবের সুরের চরিত্রে এক দিকে ছিল অপূর্ব মধুরতা, অন্য দিকে তার চলন ছিল জটিল। যেমন, ‘রেশমা অওর শেরা’ ছবিতে মান্না দে ও লতাজির গাওয়া ‘তু চন্দা ম্যায় চাঁদনি’ গানটি শুনলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। মান্ড রাগাশ্রিত এই গানের চলনজটিলতা অনায়াসে হাসিল করেছেন লতাজি। চলনজটিলতা, কারণ, অন্তরা থেকে মুখে ফেরার আগে এক জায়গায় গারা রাগও মিশিয়েছেন জয়দেব। তাঁরই সুরারোপিত ‘আলাপ’ ছবির শেষ গান ভৈরবী রাগে বাঁধা ‘মাতা সরস্বতী সারদা’ গানটি যেন লতাজির কণ্ঠেই অমন মহিমাময় হয়ে উঠতে পেরেছিল। আবার, ‘সেহরা’ ছবিতে ‘তুম তো প্যায়ার হো’ গানটি লতাজির সঙ্গে গেয়েছিলেন মহম্মদ রফি। মারুবেহাগ রাগে তৈরি এই গান থেকে গিয়েছে শ্রোতাদের হৃদয়ে, হারিয়ে গিয়েছেন তার সঙ্গীত পরিচালক রামলাল। হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরে লতাজি গেয়েছেন ‘শ্রীরামচন্দ্রকৃপালু ভজ মন হরণ ভবভয় দারুণম্’। ইমন-আশ্রিত এই গান কোনও ফিল্মের জন্য রেকর্ড করা হয়নি। লতাজির গাওয়া একটি ভজনের অ্যালবামে এই গানটি পাওয়া যায়।
সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতাজি অনেক অবিস্মরণীয় গান উপহার দিয়েছেন। স্থানাভাবে সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম না। এই সংক্ষিপ্ত দ্রুত রচনাটির মধ্যে এল না লতাজির অতুলনীয় বাংলা গানগুলির প্রসঙ্গও। হেমন্তবাবুর সুরে বাগেশ্রী রাগে গাওয়া লতাজির ‘কেন গেল পরবাসে বল বধুঁয়া’ বা ভৈরবীতে গাওয়া ‘কে যেন গো ডেকেছে আমায়— এই রকম অনেক গানও আমাদের মনে চিরজীবী। আমাদের জীবনের এক বিশেষ অংশ ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর বিদায় আমাকে আরও বেশি করে টেনে আনবে তাঁর গানের কাছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy