ছাত্র-ভোট বা ভর্তি নিয়ে বিবাদ নয়, রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে এ বার সরস্বতী পুজো করতেও পুলিশ মোতায়েন নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ কলকাতায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কলেজের প্রাক্তনী, সেই প্রতিষ্ঠানের ঘটনার গভীরে গেলে অবশ্য টের পাওয়া যাচ্ছে, সরস্বতী পুজো নিয়ে বিবাদ শুধু উপলক্ষ। নেপথ্যে রয়েছে সেই ‘দখলদারি ও দাদাগিরি’র রাজনীতি। বিরোধী দল ও ছাত্র সংগঠনগুলিরও অভিযোগ, সর্বত্র শাসক দলের ক্ষমতাশালীদের ‘হুমকি সংস্কৃতি’র ফলেই এই পরিস্থিতি।
দক্ষিণ কলকাতার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজে দুই গোষ্ঠীর বিরোধের জেরে পুলিশি পাহারায় পুজোর আয়োজনের ব্যবস্থা করেছে কলকাতা হাই কোর্ট। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে প্রশাসন ও শাসক দলকে বিঁধেছে বিরোধীরা। চাপে পড়ে বিষয়টি সম্পর্কে রিপোর্ট চাইতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। নদিয়ার হরিণঘাটাতেও একটি প্রাথমিক স্কুলে সরস্বতী পুজোর আজোয়নে পুলিশি ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয়দের একটি অংশের দাবি, এলাকার এক প্রভাবশালীর হুমকিতেই পুজো নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছিল। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য গোটা বিষয়টিকে শাসক তৃণমূলের সংখ্যালঘু তোষণের ফল হিসেবেই দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়েই এই দাদাগিরি চলছে।’’
রাজ্যের কলেজগুলিতে ছাত্র-ভোট অন্তত পাঁচ-ছ’বছর বন্ধ থাকায় নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। তার মধ্যে যোগেশচন্দ্র কলেজে তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনেরই দুই গোষ্ঠীর বিরোধে এ বার পুজো নিয়ে নজিরবিহীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এক ছাত্র-নেতার হুমকিতেই এ বার পুজো নিয়ে অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ। হুমকিতে অভিযুক্ত সেই যুবক রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলেও তৃণমূল সূত্রের খবর। তাঁর এই ভূমিকায় দল ও প্রশাসনকে যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমও। তাঁর কথায়, ‘‘এটা অসভ্যতা। সরস্বতী পুজো যেমন ধর্মীয় ব্যাপার, তেমনই তা বাঙালির সংস্কৃতি। তা নিয়ে এই বিরোধ কোনও ভাবেই প্রত্যাশিত নয়।’’ অভিযুক্ত ছাত্র-নেতা অবশ্য নিজের কাজে অন্যায় দেখছেন না। কলেজে সোমবারও বহাল তবিয়তেই ছিলেন তিনি।
যোগেশচন্দ্র কলেজে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে ঘিরে পড়ুয়াদের ক্ষোভ জানানোর সূত্র ধরে এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে বলছেন, “এক ধরনের গুন্ডাশ্রেণি তৈরি করা হয়েছে, যারা ক্যাম্পাসে সরাসরি তৃণমূলের পতাকা নিয়ে মাতব্বরি করছে। আর এক ধরনের গুন্ডাদের সরকার ক্যাম্পাসের গেটে বসিয়ে রাখছে, যাতে ওই মাতব্বরিটা দ্বিগুণ করা যায়। মাতব্বরি বন্ধ করতে গেলে অবাধ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে।’’ ডিএসও-র রাজ্য সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়ের বক্তব্য, ‘‘যেখানে রাজ্য জুড়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই, সেখানে ছাত্র সংসদের নাম করে ছাত্র-ছাত্রীদের দেওয়া সরস্বতী পুজোর অর্থ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কোন গোষ্ঠীর হাতে যাবে এবং তারা সেই টাকায় ক্ষমতার আস্ফালন চরিতার্থ করবে, এই নিয়ে উত্তেজনা। শাসকের মদতে পুষ্ট বহিরাগতেরা কলেজের অভ্যন্তরে দাপাদাপি এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরকে পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত থাকে। অন্য দিকে, সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এই উত্তেজনাকে হাতিয়ার করে রাজ্য জুড়ে বিজেপি-আরএসএস বিভেদ তৈরির রাজনীতি করছে।’’
এমতাবস্থায় যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ল’কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ইউনিটের তরফে বিবৃতি দিয়ে দাবি করা হয়েছে, ‘কলেজের প্রাক্তনী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্ন প্রতিটি কলেজের ছাত্র সংসদকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের আদলে তৈরি করা। স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে সবার আগে কলেজগুলিকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের মতো সুরক্ষিত করা জরুরি। এই লড়াই মুখ্যমন্ত্রীর আদর্শে দীক্ষিত ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অপরাধী, সমাজবিরোধী এক দল ক্ষমতালোভীদের’। শাসক ছাত্র সংগঠনের ইউনিট কাদের ‘সমাজবিরোধী’ বলছে, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এই সূত্রেই অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ২০১৭ সালে বলেছিলেন, প্রতি বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন না-করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ধাঁচে কলেজের পরিচালন সমিতিগুলিই ছাত্রদের নিয়ে বোর্ড তৈরি করে দিক। প্রসঙ্গত, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র কাউন্সিল অরাজনৈতিক।
নদিয়ার হরিণঘাটায়ও একটি প্রাথমিক স্কুলে সরস্বতী পুজোর আজোয়নে পুলিশি ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। কেন পুজোর আয়োজনে পুলিশ? স্থানীয়দের একটি অংশের দাবি, এলাকার এক প্রভাবশালীর হুমকিতেই পুজো নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছিল। তারপরই প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়ায় এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা আলিমুদ্দিন মণ্ডল পুজো বন্ধের হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করে সোমবার তিনি বলেন, ‘‘এলাকার মানুষ একত্রিত হয়ে জোট বাঁধতেই হুমকি, চোখ রাঙানি উবে গিয়েছে। কচিকাঁচা পড়ুয়া ও অভিভাবকেরা উপস্থিত হন। নির্বিঘ্নে পুজো হয়েছে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)