Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

দূষণের বিষ বুকে নিয়েও কারখানাই সম্বল

চৈত্রের হাওয়ায় দুলছে সারি সারি গাছের কালচে পাতা। পাশ দিয়ে বইছে এক চিলতে জলের ধারা। ওটাই সিঙ্গারন নদী। তিরতির করে বইছে মেটে লাল জল।

দূষণে কালো সিঙ্গারন নদীর জল। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

দূষণে কালো সিঙ্গারন নদীর জল। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

গার্গী গুহঠাকুরতা 
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:০০
Share: Save:

চৈত্রের হাওয়ায় দুলছে সারি সারি গাছের কালচে পাতা। পাশ দিয়ে বইছে এক চিলতে জলের ধারা। ওটাই সিঙ্গারন নদী। তিরতির করে বইছে মেটে লাল জল। পিছনে কারখানার চিমনি কালো ধোঁয়ায় আকাশ ভরাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে বুধন বাউড়ি বললেন, ‘‘জানেন, এক সময় এই নদীর জলে স্নান করত সবাই। এই জল খাওয়াও যেত। টলটলে জলের পাশে বনভোজন হত।’’

জামুড়িয়া শিল্পতালুক লাগোয়া এলাকায় দূষণ এ ভাবেই থাবা বসিয়েছে। ইকড়া, চণ্ডীপুর, সার্থকপুর, বিজয়নগর, ধসর— একের পর এক গ্রামের মাটিতে ছাইয়ের আস্তরণ পড়েছে। বাড়ির মেঝে কালো হচ্ছে। গাছের পাতাও কালো। বুড়ো থেকে বাচ্চা, প্রায় সকলেই কমবেশি শ্বাসকষ্ট, সর্দি নিয়ে বছরভর দিন কাটায়।

২০০৩ সালে ইকড়ায় প্রথম চালু হয় স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। এখন তার সংখ্যা ১২। বিজয়নগরে রয়েছে আরও দু’টি। দূষণ নিয়ে প্রতিবাদও কম হয়নি। তৈরি হয়েছিল ‘দূষণ প্রতিরোধ কমিটি’। এমনকি বিধানসভার প্রতিনিধি দলও ঘুরে দেখে গিয়েছেন বাস্তব চিত্র। তার পরে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। কারখানা মালিকরাও দূষণ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। বুধনের দাবি, একেবারে যে কাজ হয়নি, তা নয়। তবে পাকাপাকি ভাবে সুরাহা হয়নি। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, কারখানাগুলিতে দূষণ ঠেকাতে বিশেষ যন্ত্র বসানো হলেও তা সব সময় কাজে লাগানো হয় না। কারণ যন্ত্র চালানোর খরচ আছে।

তবে দূষণ নিয়ে যত সমস্যাই হোক, তা নিয়ে পথে নামার মতো অবস্থা বুধনদের নেই। কারখানা চলছে বলেই পেট চালাতে পারছেন কয়েক হাজার মানুষ। প্রায় হাজার একরের শিল্পতালুকের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে ইস্পাত কারখানা। এর মধ্যে ৯টি শুধুই স্পঞ্জ আয়রন উৎপাদন করে। তিনটি ‘ইন্টিগ্রেটেড’ কারখানা। অর্থাৎ স্পঞ্জ আয়রন থেকে ইস্পাতের রড, বার ইত্যাদি সবই তৈরি হয়ে এই তিনটি কারখানায়। এ ছাড়া রয়েছে পেরেক তৈরির ৪টি কারখানা, ৫টি সিমেন্ট কারখানা, ২টি প্লাস্টিক সামগ্রীর ও একটি ‘রিফ্র্যাক্টরি’ কারখানা। সব মিলিয়ে ৮০০০ মানুষের রুজি-রুটি জোগায় এই তালুক। তাই দূষণ নিয়ে মাথা ঘামানোর ‘বিলাসিতা’ দেখাতে পারেন না বুধনরা। ভোট এলেও নয়। বুধনের স্পষ্ট কথা, ‘‘ভোট চাইতে এসে অনেকে অনেক কথা বলেন। তার পরে ভুলে যান। প্রতিবাদ করে কাজ হারালে খাব কী? আমাদের এ ভাবেই বেঁচে থাকতে হবে।’’

ভয়টা অমূলক বলা যায় না। শিল্পাঞ্চলে সরকারি বিনিয়োগের ধারা বহু আগেই শুকোতে শুরু করেছে। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের বিনিয়োগে তৈরি হওয়া সংস্থাগুলি প্রায় সবই একে একে বন্ধ হয়েছে। বাকিগুলিও ধুঁকছে। আর এদের

টানে যে সব বেসরকারি পুঁজি ভিড় করেছিল, তাদের অধিকাংশেরই বাতি নিভেছে। হিন্দুস্থান পিলকিংটন গ্লাস, হিন্দুস্থান শিট মেটালস, এশিয়াটিক অক্সিজেন, হিন্দুস্থান রিফ্র্যাক্টরির মতো সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই স্পঞ্জ আয়রন, ফেরো-অ্যালয় ইউনিটই রোজগারের ভরসা।

জামুড়িয়া ছাড়াও শিল্পাঞ্চলে রয়েছে আরও চারটি শিল্পতালুক। কন্যাপুর, মঙ্গলপুর, বামুনারা, অঙ্গদপুর। সব মিলিয়ে লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে বলে দাবি করলেন রানিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সন্দীপ ভালোটিয়া। তবে সম্ভাবনার তুলনায় তা নেহাতই কম বলে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘পুঁজি টানতে চাই সরকারি হস্তক্ষেপ। সরকারি নীতি রয়েছে। প্রকল্পও রয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে লাল ফিতের ফাঁস এখনও বাধা।’’ এবং এ বিষয়ে কেন্দ্র-রাজ্য, দুই-ই সমান। কাঁচামাল পাওয়ার সমস্যা, ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য ‘কোল লিঙ্কেজ’ নীতিতে খামতি থেকে গিয়েছে। জামুড়িয়ায় ১০টি রিফ্র্যাক্টরি ইউনিট ছিল। এখন ৯টি বন্ধ। একটি মাত্র কারখানা চলছে। মূলত ‘ইয়োলো ক্লে’ নামে প্রধান কাঁচামালের সরবরাহ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। কারখানা মালিকদের অভিযোগ, কাঁচামাল কেনার সময় পাকা বিল মেলে না। কিন্তু কারখানায় তৈরি পণ্য বাজারে নিয়ে যেতে পাকা বিল জরুরি।

এত সমস্যা নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের কাছে দরবার করেননি? এ প্রশ্নের উত্তরে মালিক পক্ষ ও শ্রমিকের বক্তব্যে ফারাক নেই। দু’পক্ষেরই অভিযোগ, ‘‘ভোটের সময় ছাড়া নেতাদের দেখা মেলে কই? ভোটের প্রচারেও আমাদের কথা নেই। শুধু একে অপরকে দোষারোপ করতেই ওঁরা ব্যস্ত।’’

ফলে গতিমুখ হারিয়ে যাওয়া সিঙ্গারন নদীর এখন বর্ষার জলই ভরসা। বছরের ওই সময়টুকু সে নিজের চেহারা ফিরে পায়। (চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Jamuria Indutrial HUb Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy