তহিরুদ্দিন মণ্ডল
গাড়িতে ওঠার আগে চায়ের ভাঁড়টা এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে, ছিটকে এসেছিল কথাটা, ‘‘আমার তালুকে অবরোধ! ঘাড়ে কয়ডা মাথা আসে দেহি তো!’’
শীতের সকালে জলঙ্গির ছোট্ট গঞ্জ ধনীরামপুরে তৃণমূল পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল তহিরুদ্দিন মণ্ডল। পাড়ার একটা ছোট্ট ঘটনার সালিশি করতে সেই সময়ে পার্টি অফিসে আসা এক গ্রামবাসীর এখনও মনে আছে— ‘‘একেবারে সিনেমার মতো জানেন তো, তহির উঠল আর তার সঙ্গে যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়াল তার পাঁচ-ছ’জন শাগরেদ। ঝটাঝট গাড়ির দরজা বন্ধ হল, তার পর সেটা চলে গেল সাহেবনগরের দিকে। তখনই জানতাম কিছু হতে চলেছে!’’
জানুয়ারির সেই সকালে খবরটা এসেছিল কিছু ক্ষণের মধ্যেই— দু’দুটো মানুষের প্রাণ গিয়েছে। ঘটনা হল, তহিরের অনুমোদন না নিয়ে এনআরসি-র বিরোধিতায় পথ অবরোধ করেছিল জলঙ্গির একটি সংগঠন। ২৯ জানুয়ারির সেই সকালে অবরোধ তুলতে গিয়েই অশান্তি। অভিযোগ, তহিরের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন দু’জন। সেই থেকে সে এলাকা ছাড়া। পুলিশ তার ‘দেখা’ পায় না। তবে তাকে ‘দেখা’ যায়, কখনও বাংলাদেশ সীমান্তের বর্ডার রোডে সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে, কখনও করোনার ছায়ায় মুখে আষ্টেপৃষ্টে গামছা বেঁধে তুমুল শব্দের মোটকবাইকে গ্রামের চৌহদ্দিতে। কখনও গ্রামীণ সালিশিতে ‘তহিরের নির্দেশ’ মেনে মাথা নিচু করে ফিরে যায় অভিযোগকারী। কখনও বা মাদক কিংবা গরু পাচারের দায়ে ধরা পড়ে ছাড় মিলে যায় ‘তহিরের লোক’ বলে।
ধনীরামপুরের এক বাসিন্দা বলছেন, ‘‘তহিরকে চোখে পড়বে না কেন, কিন্তু পুলিশ তা দেখতে পায় না। আগ বাড়িয়ে আমি নালিশ করতে গেলে লাশই যে খুঁজে পাওয়া যাবে না!’’ জলঙ্গির তৃণমূল ব্লক সভাপতিকে তাই দেখেও দেখতে নেই। জেলা পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার অবশ্য সে কথা মানছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘না না, তহির তো ফেরার। ওর সন্ধানে বহু জায়গায় তল্লাশি চলছে। তবে আমরা সাহেবনগরের ঘটনায় আদালতে ওর নামে চার্জশিট জমা দিয়েছি।’’ চার্জশিটে খুন, প্রাণনাশের হুমকি, বেআইনি ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা, এলাকায় গন্ডগোল পাকানোর অভিযোগ রয়েছে তহিরের নামে।
আরও পড়ুন: ছোঁয়াচ-বিধি শিকেয় তুলে রাজনীতি, প্রশ্নে দায়িত্ববোধ
ফেরার তহির অবশ্য এখনও রয়ে গিয়েছে দলীয় পদে। ধনীরামপুরের দলীয় কার্যালয়ে তাঁর চেয়ারে নাকি এখনও কেউ বসার সাহস পান না। দলের এক স্থানীয় নেতা বলছেন, ‘‘আমরা না দেখতে পেলেও তহির আমাদের দেখতে পায়!’’ এলাকার এক একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতাও বলছেন, ‘‘সীমান্তে বাঁচতে গেলে তহিরকে তোয়াজ না করলে চলে!’’ আর জলঙ্গির কংগ্রেস নেতা আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা তো কবুল করছেন, ‘‘বিরোধিতা দূরের কথা, এলাকার মানুষ তার বিরুদ্ধে ফিসফাস করলেও রক্ষে নেই, হ্যাঁ এখনও। আর মনে রাখবেন, বিরোধীরা এলাকায় মিটিং-মিছিল করতে গেলেও তহিরের অনুমতি লাগে।’’
আরও পড়ুন: নতুন করে ঘরে বন্দি বর্ধিত কন্টেনমেন্ট জ়োনে, কাল বিকেল ৫টা থেকে
কারণ, তহির যে বিরোধিতা শব্দটা একেবারেই পছন্দ করে না, জানান তার একদা সহপাঠী। বলছেন, ‘‘কোনও বিরোধিতা তহির কখনও মেনে নিতে পারত না। শিক্ষকেরাও তাই বিশেষ ঘাঁটাতেন না ওকে। রাজনীতিতে পা রাখার পরে সেই দাপট উত্তরোত্তর বেড়েছে।’’ এলাকা জানে, ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসা ছেলেটাই সদ্য তরুণ বয়সে হয়ে উঠেছিল ‘সীমান্তের ডন’। আর তা নিয়ে বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে নিরন্তর ‘ষুদ্ধ’। ব্যাঙ্ক ব্যালান্সও দৃশ্যত ফেঁপে ওঠে। আর সেই সুবাদে স্থানীয় রাজনীতির দাদাদের কাছাকাছি এসে পড়েছিল সে।
২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে মূলত তহির বাহিনীর দাপটে এলাকা ছাড়া হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা। রাজ্যে পালাবদলের পরেও তার স্বভাব বদলায়নি। স্কুলে ঢুকে ছাত্র-শিক্ষকদের নির্বিচারে মারধর, দেবীপুর বাজারে দোকান লুট, বাম-কংগ্রেসের ডাকা বন্ধে বিরোধীদের বেধড়ক মারধর— একের পর এক ঘটনা। তবু কিছু দিনের মধ্যেই ব্লক সভাপতির পদ। স্থানীয় গ্রামবাসীরা বলছেন, ‘‘পদ পাওয়ার পরেই ব্লক অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে তার ঘোষণা ছিল — ‘‘আমার কথার পাল্টা কথা যেন কেউ না কয়!’’
এত কিছুর পরেও দল তাকে সরায়নি কেন? তৃণমূলের জেলা সভাপতি আবু তাহের খান বলছেন, ‘‘ও তো ফেরার, ওকে আর অপসারণ করা হবে কী করে। তবে কিছু দিনের মধ্যেই দলীয় পদে রদবদল হবে, তখন ওকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।’’ যা শুনে দলেরই এক স্থানীয় নেতা বললেন, ‘‘বুকের পাটা আছে যে তাহিরকে সরাবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy