(বাঁ দিকে) ভাঙড়ের বিধায়ক তথা আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি এবং ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক তথা তৃণমূলের ভাঙড়ের পর্যবেক্ষক শওকত মোল্লা। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পর থেকে বাংলার নানা জায়গায় শাসক-বিরোধীর সংঘর্ষ, বোমাবাজি, হাতাহাতি এমনকি, গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে। তার মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় শুরু থেকেই প্রথমে। নিত্য দিন সেখানে লেগে রয়েছে অশান্তি। তৃণমূল এবং আইএসএফ, ভাঙড়ের মাটিতে দুই যুযুধান রাজনৈতিক দল একে অন্যের দিকে সেই অশান্তির দায় চাপাচ্ছে। সেই আবহে সোমবার বিধানসভায় যে দৃশ্য দেখা গেল তা ব্যতিক্রমই বটে। ভাঙড়ের বিধায়ক তথা আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি এবং ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক তথা তৃণমূলের ভাঙড়ের পর্যবেক্ষক শওকত মোল্লা হাসিমুখে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন। দু’জনেই বলছেন, তাঁরা এলাকায় শান্তি ফেরাতে উদ্যোগ নেবেন। যে শওকত দিন কয়েক আগে নওশাদের এলাকা ফুরফুরায় গিয়ে ‘চোর, চোর’ স্লোগান শুনে বিড়ম্বিত হয়েছেন, যে নওশাদকে ‘সমাজবিরোধী’ বলে কটাক্ষ করেছেন শওকত, তাঁরা নিজেদের দাদা-ভাই বলে পরিচয়ও দিলেন। যা দেখেশুনে দু’জনকে বিঁধে মন্তব্য করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
অন্য দিকে, নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব থেকে উত্তপ্ত মুর্শিদাবাদের ডোমকলে প্রতিবারের ‘পরিচিত ছবি’ দেখা গেল বুধবারও। সেখানে তৃণমূল এবং সিপিএমের সংঘর্ষে সোমবার সন্ধ্যায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে। অভিযোগ, চলেছে গুলিও। তৃণমূলের দাবি, তাদের তিন জন কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আঙুল উঠেছে সিপিএমের দিকে। কিন্তু সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে সিপিএমের দাবি, তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলেই গুলি চলেছে। সিপিএমের পাল্টা অভিযোগ, তাদের মিছিলে বিনা প্ররোচনায় হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। তাতে তাদের এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে খবর, সংঘর্ষে আহত অন্তত চার জনকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। এলাকায় শান্তি ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। উল্লেখ্য, মঙ্গলবারই ডোমকলে সভা করার কথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তার আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়াও বুধবার বাংলার নানা জায়গায় বিক্ষিপ্ত অশান্তি হয়েছে।
নওশাদ-শওকত সাক্ষাৎ
শওকতকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করেন নওশাদ। ভাঙড়ে অশান্তির পর যখন একে অন্যকে তাঁরা কাঠগড়ায় তুলছেন, তখনও তৃণমূল বিধায়ককে ‘শওকাতদা’ বলে ডাকতে শোনা গিয়েছে ভাঙড়ের বিধায়ককে। সোমবারও বিধানসভায় মুখোমুখি হওয়ার পর ‘দাদা’ই বলেছেন আইএসএফ বিধায়ক। তবে তার পরে যে ভাবে দু’জনে মিলে সাংবাদিক বৈঠক করলেন, তাতে অশান্ত ভাঙড়ের জন্য ভাল বার্তা গেলই বলে মনে করা হচ্ছে। নওশাদ বললেন, ‘‘শওকতদা আমার দাদার মতো। তাঁকে পাশে নিয়েই আমি শান্তি ফেরাতে চাই (ভাঙড়ে)।’’ ভাঙড়ে শান্তিপ্রতিষ্ঠা করতে সপ্তাহখানেক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ পেতে নবান্নে পৌঁছে গিয়েছিলেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ। তবে দেখা হয়নি। সোমবার নওশাদের মতো শান্তি ফেরানোর কথা বলেছেন শওকতও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সব সময় শান্তির পক্ষে। শান্তিস্থাপনের পক্ষেই আমরা কাজ করে যাব। ওরা (নওশাদ) যদি ভাঙড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা হলে আমরা সব সময় রাজি।’’
রাজনীতিকদের একাংশের মতে, বিধানসভায় মুখোমুখি হয়ে যাওয়াতেই দুই নেতা সৌজন্যবশত এমন কথা বলেছেন। কিন্তু ভাঙড়ের রাজনীতি সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন, মুখের কথায় শান্তি ফিরবে না। তাই বিধানসভায় শাসক-বিরোধী সৌজন্য দেখা গেলেও, বাস্তবের মাটিতে তার কতটা প্রতিফলন দেখা দেবে তা নিয়ে সন্দিহান রাজনীতিকদের ওই অংশ। তবুও নওশাদ-শওকতের এই শান্তি ফেরানোর ‘সন্ধি’ তাৎপর্যপূর্ণ।
নওশাদ-শওকত পায়রা ওড়ান
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বের আগে থেকেই উত্তপ্ত ভাঙড়। তৃণমূল এবং আইএসএফের সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। এলাকায় শান্তি ফেরাতে সেখানে রাজ্যপালও গিয়েছেন। এর মধ্যে সোমবার বিধানসভায় নওশাদ-শওকতের ‘সৌজন্যে’র ছবি দেখা গিয়েছে। হাসিমুখে দুই বিধায়কই সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। কিন্তু এতে ‘আশাব্যঞ্জক’ কিছু দেখছেন না বিরোধী দলনেতা তথা নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু। সোমবার হুগলির জাঙ্গিপাড়ায় সভা করেন তিনি। সেখানে ওই ‘সাক্ষাৎপর্ব’কে কটাক্ষ করে দুই বিধায়ককে তাঁর ‘পরামর্শ’, শান্তি ফেরাতে তাঁরা পায়রা ওড়ান। শুভেন্দুর কথায়, ‘‘দু’জনে যদি ভাঙড়ের গ্ৰামে গ্ৰামে গিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তা হলে ভাল। কিন্তু ঠান্ডা ঘরে নিরাপদ জায়গায় বসে এটা করবেন না। কারণ, দু’পক্ষেরই লোক (সংঘর্ষে) মারা গিয়েছেন। তাঁরা সবাই গরিব মানুষ।’’ শুভেন্দুর সংযোজন, ‘‘আমি বলব, দু’পক্ষের পতাকা সরিয়ে দিয়ে ওঁরা ভাঙড়ের গ্রামে গ্ৰামে গিয়ে সাদা পতাকা নিয়ে শান্তি মিছিল করুন। কিছু সাদা পায়রাও নিয়ে যান। মাঝেমধ্যে ওড়াতে ওড়াতে যাবেন।’’
পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধির দাবি
সোমবারই একাধিক দফায় পঞ্চায়েত ভোট করানোর দাবি জানিয়েছেন ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ। সোমবার এই মর্মে কলকাতা হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেছেন তিনি। হলফনামায় বলা হয়েছে, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে যদি যথেষ্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী পঞ্চায়েত ভোটে মোতায়েন না করা যায়, তবে এক দফার বদলে একাধিক দফায় ভোট করানো হোক। নওশাদের কথায়, ‘‘এ বার পঞ্চায়েতে পাঁচটি জেলা বেড়েছে। বেড়েছে বুথ, ভোটারও। তাই যদি যথেষ্ট বাহিনী না আনা যায়, তবে পঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তার স্বার্থেই দফা বৃদ্ধি করা হোক।’’
অশান্তির নাম ডোমকল
পঞ্চায়েত ভোটের আগে উত্তপ্ত মুর্শিদাবাদের ডোমকল। তৃণমূলের অভিযোগ, তাদের জমানায় ডোমকলে যে শান্তির পরিবেশ ফিরেছিল, তা নষ্ট করতে চাইছে বাম-কংগ্রেস। তারা একত্রে আবার আগের ‘অশান্ত ডোমকল’ চায়। তবে শুধু ডোমকলই নয়, মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া, সালার, রেজিনগর এবং রঘুনাথগঞ্জ থানা এলাকায় নিত্য দিন অশান্তি হচ্ছে। সব মিলিয়ে শতাধিক বোমা উদ্ধার হয়েছে এলাকাগুলো থেকে। সোমবার দুপুরেও বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে ডোমকল পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মানিকনগর এলাকা। স্থানীয় সূত্রে খবর, যাঁর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই মসজিদুল্লা শেখ শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত। ঘটনার পর থেকেই ওই বাড়ির সকলে পলাতক। মসজিদুল্লার সঙ্গে দলের যোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছে শাসকদল। বিস্ফোরণের খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছয় ডোমকল থানার পুলিশ। মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার সুরিন্দর সিংহ বলেন, ‘‘ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছেছে। গোটা বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ এর পর সন্ধ্যায় ডোমকলে তৃণমূল-সিপিএমের সংঘর্ষ এবং গুলি চলার অভিযোগ ওঠে।
অশান্তি চলছেই
পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে উত্তর ২৪ পরগনার নিউ ব্যারাকপুরে সিপিএম এবং তৃণমূল সংঘর্ষে জড়ায়। পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে পোস্টার লাগানোর সময় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাদের উপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ তুলেছে সিপিএম। তাদের দাবি, বেশ কয়েক জন কর্মী-সমর্থক আহতও হয়েছেন। তৃণমূল অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, সিপিএমের লোকেরাই তাদের মারধর করেছে। দলের নেতা তথা নিউ ব্যারাকপুর পুরসভার চেয়ারম্যান প্রবীর সাহা বলেন, ‘‘আমরা মারিনি। আমাদের কর্মীদেরই মেরেছে সিপিএম। আমাদের দু’জন আক্রান্তও হয়েছেন। সিপিএম এখন মিথ্যে অভিযোগ করছে। আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করেছি।’’ অন্য দিকে, এক বিজেপি প্রার্থীর বা়ড়িতে বোমাবাজি করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের নাঘাটার ঘটনা। অভিযোগ, দলীয় প্রার্থীর বাড়িতে হামলার সময় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বাধা দিতে গিয়ে ‘আক্রান্ত’ হয়েছেন রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারীর বাবা ভূপাল অধিকারী এবং ভাই অনুপম অধিকারী। বিজেপির দাবি, অনুপমের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিধায়কের ভাই ছাড়াও আরও বেশ কয়েক জন আহত হয়েছেন। তাঁদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তৃণমূল অবশ্য হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। উল্টে শাসকদলের দাবি, বিজেপিই তাদের কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, সংঘর্ষের ঘটনার তদন্তে নেমে দু’পক্ষের তিন জনকে আটক করা হয়েছে। অন্য দিকে, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বর্ধমানের পূর্বস্থলী-১ ব্লকের জাহাননগর পঞ্চায়েতের বেতপুকুর গ্রামের বাসিন্দা তথা বিজেপির ৩৫ নম্বর মণ্ডলের ওবিসি মোর্চার সভাপতি হরিলাল দেবনাথের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। পুলিশের দাবি, রবিবার রাতে ওই তল্লাশিতে হরিনাথের বাড়ি থেকে কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং বোমা উদ্ধার হয়। এ নিয়ে কালনার এসডিপিও সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘হরিলাল দেবনাথের বাড়ি থেকে ৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬টি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।’’ এই ঘটনায় বিজেপি নেতৃত্ব ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy