ত্রয়ী: (উপরে) বাসের স্টিয়ারিংয়ে হাত কল্পনা মণ্ডলের। (নীচে) মালগাড়ির চালকের কেবিনে দীপান্বিতা দাস। (ডান দিকে) অ্যাপ-বাইক নিয়ে রূপা চৌধুরী।
গভীর রাত। জাতীয় সড়ক দিয়ে তীব্র গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। এক পাশে মালবাহী গাড়িটা কোনও ভাবে দাঁড় করানো গিয়েছিল। এত রাতে মিস্ত্রি কোথায়? বছর ষোলোর মেয়েটিই নেমে পড়েছিল চাকা বদলাতে। দমদমের প্রমোদনগরের বাড়িতে যখন ঢুকল সে, তখন রাত ২টো। দুর্ঘটনার পরে প্রথম বার বাবা স্টিয়ারিং হাতে দূরে বেরিয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থে সেই দিন থেকে বাবার ডান হাত কল্পনা মণ্ডল।
বছর চারেক আগের ঘটনা। সলপে এক পথ দুর্ঘটনায় বাঁ পা ভাঙে বাসচালক সুভাষ মণ্ডলের। সেরে উঠলেও আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। ধীরে ধীরে তাঁর ভরসা হয়ে ওঠেন আদরের নন্দিনী, সবাই যাঁকে কল্পনা ডাকেন। প্রতি সকালে বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মেয়ে। নোয়াপাড়া-ধর্মতলা রুটে নিয়মিত দু’টি করে মোট চারটি ট্রিপ চালান পিতা-পুত্রী। কল্পনার বাঁ পাশে মা আর পিছনে বসেন বাবা। জীবনের লক্ষ্য? আঠারো পেরোনো মেয়ের ঝটিতি উত্তর, “পুলিশের গাড়ি চালাতে চাই। বাবার ওটাই স্বপ্ন। নিজে পারেনি, তাই আমি চালালে বাবা খুব খুশি হবে।”
বাবা-মায়ের খুশির সঙ্গে নিজের আনন্দ মিশে গিয়েছিল দীপান্বিতা দাসেরও। ১৭ বছরের কর্মজীবনে গত ছ’বছর ধরে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মালগাড়ির চালক তিনি। প্রতিদিন ৫৩০০ টন ওজনের ৬০টি বগিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। মেদিনীপুর কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক বাবা এবং গৃহকর্ত্রী মায়ের সমর্থন তো ছিলই। বিয়ের পরে পরিবারও পাশে থেকেছে তাঁর। এগারো বছরের মেয়ে লাবণ্য আর ছ’বছরের সার্থকের কাছে আদর্শ তাঁদের মা। গর্বিত মা তাই উচ্ছ্বসিত নিজের কাজ আর সংসার নিয়ে।
কিন্তু সব মায়ের লড়াই কি স্বীকৃতি পায়? নিজের আর আপনজনের খুশি সব ক্ষেত্রে মিলেও যায় না। তখন নিজের খুশি বা পছন্দকে বেছে নিলে লড়াই সহজ হয়। যেমন হয়েছে রূপা চৌধুরীর। এ শহরের প্রথম খাবার সরবরাহকারী মেয়েটি এখন অ্যাপ-বাইক চালান। ওঁর পছন্দ ড্রাইভিংই জুড়ে দিয়েছে ভিন্ন পেশায়। যে কারণে আজ রূপা পরিচিত মুখ, কিন্তু অপরিচিত তাঁর একার লড়াই। বাধ্য হয়েই ছ’বছরের ছেলেকে রেখে বাবার কাছে এসেছিলেন। অসুস্থ বাবার সেবা করতে খাবার সরবরাহকারীর চাকরিতে ঢোকেন।
একে একে চলে গিয়েছেন বাবা, বড়দিদি। মা সেই ২০০৬ সালে। আর এক দিদি খবর রাখেন না বোনের। বিয়ের ব্যর্থতা নিয়ে কাউকে দোষারোপ করেন না বাঘা যতীনের বছর বত্রিশের রূপা। ছিন্ন সম্পর্কের ভিড়ে পাশে পেয়েছেন বন্ধু অপর্ণা দাসকে। কোনও স্বপ্ন? “দেখি না। তবে এগারো বছরের ছেলে সায়ন্তনের সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগে।” অবসরে মোবাইলে গেম খেলেন। শ্রেয়া ঘোষালের ভক্ত রূপা ভাবেন না অন্য পেশার কথা।
নিজেকে সতেজ রাখতে বাড়ি ফিরে মোবাইলে গোপাল ভাঁড় দেখেন। ‘জিনা ইয়াহাঁ মরনা ইয়াহাঁ, ইসকে সিবা জানা কাহাঁ’ কলার টিউনেই ধরা থাকে ওঁর যন্ত্রণা।
এমন লড়াকু চালিকাশক্তিদের জন্য বরাদ্দ বছরের একটি দিন! বিশ্ব নারী দিবস আলাদা মাহাত্ম্য রাখে ওঁদের জন্য? ওঁরা চান, স্মরণ করতে একটি দিন, ঠিক আছে। কিন্তু সম্মান আসুক ৩৬৫ দিন। এ জন্য কাজ করতে হবে মেয়েদেরই। যেমন, নিজেদের কাজ দিয়েই বাঁকা চাহনি বদলে দিচ্ছেন কল্পনা-রূপা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy