সিদ্ধেশ্বর স্যার বলে ছোট থেকে ওঁকে আমরা ডাকি। সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী। আমাদের গ্রাম, বর্ধমানের সুয়াতায় ওঁর বাড়ি। জামতাড়া হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। মাসের বারোটা দিন পেরিয়ে গিয়েছে। সিদ্ধেশ্বর স্যার আজ পর্যন্ত পেনশনের এক টাকাও তুলতে পারেননি।
সিদ্ধেশ্বর স্যার পেনশন তোলেন এসবিআইয়ের হাটকীর্তিনগর শাখা থেকে। মাসের প্রথম সপ্তাহে তিন দিন সকাল থেকে টানা বিকেল পর্যন্ত ওখানেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু টাকা পাননি। প্রথম দিন নিজের শারীরিক অবস্থার কথা ব্যাঙ্ককর্মীদের বার বার বুঝিয়েও কাজ হয়নি। তিন দিন পর নিজে আর টানা অত ক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে পারবেন না বুঝে ৭ ডিসেম্বর নাতনিকে সঙ্গে এনেছিলেন। টানা চার ঘণ্টা কখনও নাতনিকে, কখনও নিজে দাঁড়ানোর পর ব্যাঙ্কের দরজার কাছাকাছি পৌঁছে শুনলেন, টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। টানা চার দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় বিরক্ত ও আতঙ্কিত সিদ্ধেশ্বর স্যার আর ব্যাঙ্কে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।
অঙ্গনওয়াড়ি-কর্মী আমার মায়েরও এক অভিজ্ঞতা। বেতনের টাকা তুলতে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিন দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লাইনে ঠায় দাঁড়িয়েও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে মা-কে। আর্থারাইটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী আমার মা নিজে এক টানা লাইনে দাঁড়াতে পারবেন না বলে বৃদ্ধ বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বাবা বজলুল কাদের চৌধুরী হার্টের রোগী। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। প্রথম দিনই বাবা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘বয়স্কদের কেন আলাদা লাইন থাকবে না?’’ কেউ কানে তোলেনি। তৃতীয় দিন দুপুরে ক্যাশ ভ্যানে করে ব্যাঙ্কে নগদ পৌঁছতেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাহকদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি শুরু হয়, অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা। তার পর থেকে আর ব্যাঙ্কে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না মা-ও।
আমাদের পাশের গ্রাম অভিরামপুরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিতাই লাহা বা এড়াল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্যামা সাঁইয়েরও দুর্ভোগের শেষ নেই। ওঁরাও টানা তিন দিন ব্যাঙ্কে ঠায় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টাকা পাননি। দু’দিন ব্যাঙ্কের লম্বা লাইনে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়েও টাকা পাননি সুয়াতার বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী সুধাকর ঘোষ। উচ্চ রক্তচাপে ভোগা, সত্তরোর্ধ্ব সুধাকরবাবুকে নিয়ম করে ওষুধ খেতে হয়। পেনশনের টাকা না পাওয়ায় ধারদেনা করে ওষুধ কিনে খেতে হচ্ছে তাঁকে।
হাটকীর্তিনগরে থাকেন বাহাদুরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকেশ দত্ত। তিন দিন ব্যাঙ্কে এসেও বেতনের টাকা তুলতে না পেরে বিপাকে তিনি। গত সপ্তাহে দু’দিন প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা পাননি। তার পর, সোমবার সকাল দশটায় ব্যাঙ্কের সামনে ২০০ জনের পিছনে লাইন দেন। দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও ব্যাঙ্কে টাকা না আসায় বিরক্ত হয়ে চলে এসেছেন লোকেশবাবু। তাঁর ছেলেমেয়ে বাইরে থেকে পড়াশোনা করে। এ মাসে তাদের টাকা পাঠাতে পারেননি তিনি।
আমার কর্মস্থল কলকাতার অবস্থা এখন সামান্য উন্নত হলেও আমাদের গ্রাম থেকে চার কিলোমিটারের মধ্যে চারটি এটিএমের কোনওটিতেই টাকা নেই নোট বাতিলের পর থেকে। কাছাকাছি শহর বলতে ৩০ কিলোমিটার দূরের বর্ধমান। কিন্তু দিনে দু’-আড়াই হাজার টাকা তুলতে গাড়ি ভাড়া করে বর্ধমান যেতে সাহস পাচ্ছেন না কেউ। বর্ধমান গেলেও যে টাকা মিলবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? এসবিআইয়ের হাটকীর্তিনগর শাখার পেনশেনভোগী, চাকরিজীবী গ্রাহকেরা তাই অসহায়। প্রায় কুড়িটি গ্রামের বাসিন্দা, কুড়ি হাজার গ্রাহক এই ব্যাঙ্কের।
প্রবীণ নাগরিকদের আলাদা লাইন নেই, সে কথা স্বীকার করতে চাননি এসবিআইয়ের হাটকীর্তিনগর শাখার ম্যানেজার সত্যজিৎ ভৌমিক। তবে পেনশনভোগী, চাকরিজীবীদের টাকা না পাওয়ার কথা তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রোজ গড়ে গ্রাহকদের নগদের চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজন ৬০ লক্ষ টাকা। কিন্তু আসছে মাত্র ৬ লক্ষ টাকা। আমরা অসহায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy