সেলিম সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হলেন এমন একটা সময়ে, যখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভা বা বিধানসভায় সিপিএমের একজন প্রতিনিধিও নেই। বছরখানেক আগের বিধানসভা ভোটে গোটা রাজ্যে সিপিএম একটি আসনও জেতেনি। নতুন রাজ্য সম্পাদকও হেরে গিয়েছিলেন হুগলির চণ্ডীতলা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। ফলে তাঁকে ‘শূন্য’ থেকেই শুরু করতে হবে।
গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
মাঝখানে কেটে গিয়েছে ১৬টি বছর। অনিল বিশ্বাসের ছেড়ে যাওয়া রাজ্য সম্পাদকের চেয়ারে বসলেন মহম্মদ সেলিম। সিপিএমের অন্দরে সকলেই জানতেন, অনিলের অঙ্গুলিহেলনেই এক দিন রাজ্যের পাট চুটিয়ে দিল্লি পাড়ি দিতে হয়েছিল অধুনা দলের পলিটব্যুরো সদস্য সেলিমকে। বৃহস্পতিবার সেই সেলিমই এলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হয়ে। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই বললেন, ‘‘মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে, মানুষকে পাশে নিয়েই আগামী দিনে আন্দোলন চলবে।’’
আন্দোলন চালানো ছাড়া সিপিএমের কাছে বিশেষ উপায়ও নেই। সেলিম সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হলেন এমন একটা সময়ে, যখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভা বা বিধানসভায় সিপিএমের একজন প্রতিনিধিও নেই। বছরখানেক আগের বিধানসভা ভোটে গোটা রাজ্যে সিপিএম একটি আসনও জেতেনি। নতুন রাজ্য সম্পাদকও হেরে গিয়েছিলেন হুগলির চণ্ডীতলা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। ফলে তাঁকে ‘শূন্য’ থেকেই শুরু করতে হবে। আক্ষরিক অর্থেই।
সংসদীয় বা পরিষদীয় রাজনীতিতে অনতি-অতীতে সেলিমের রেকর্ডও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ২০২১ সালে বিধানসভায় হেরে যাওয়ার আগে ২০১৯-এর লোকসভায় সেলিম লড়েছিলেন উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ কেন্দ্র থেকে। সেখানেও বিজেপি-র দেবশ্রী চৌধুরীর কাছে হার স্বীকার করতে হয়। শেষ ভোটে জয় তারও পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে রায়গঞ্জ থেকে। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সে বারও সেলিমের জয় এসেছিল কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি এবং তৃণমূল প্রার্থী সত্যরঞ্জন দাশমুন্সির ভোট কাটাকুটির ফলে। মাত্রই ১,৬৩৪ ভোটে জিতেছিলেন সেলিম।
তবে বিপন্ন সিপিএমে নয়া অক্সিজেন সঞ্চারের চেষ্টা শেষ বিধানসভা ভোটের আগেও করেছিলেন সেলিম। ফুরফুরার পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির দল আইএসএফ-এর সঙ্গে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের জোট বাঁধার ব্যাপারেও সামনের সারিতে ছিলেন সেলিম। রাজ্যের বিপুল বাংলাভাষী সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের ভোটকে পুঁজি করে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে চেয়েছিলেন তৃণমূল এবং বিজেপি-কে। তাতেও বিতর্ক কম হয়নি। জোটের ব্রিগেড সমাবেশে আব্বাসের প্রবেশ এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। প্রবীণ নেতারা কোনও মতে অধীরের মানভঞ্জন করেন। কিন্তু ‘জোট’ কখনওই জমে ওঠেনি। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের মতোই সিপিএম-কংগ্রেস জোট খানিকটা ছাড়া-ছাড়া ছিল। ভোটের ফলাফলে গোটা রাজ্য থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সিপিএম এবং কংগ্রেস। একটিমাত্র আসন পায় আইএসএফ। সেই সময় সেলিমের ‘আব্বাস-পদক্ষেপ’-এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন সিপিএমের প্রথম সারির নেতারাও। সেই সেলিমের হাতেই বর্তাল বঙ্গ সিপিএমে নতুন প্রাণসঞ্চারের দায়িত্ব।
সিপিএমে সেলিমের উত্তরণ যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। মৌলনা আজাদ কলেজের দর্শনের স্নাতক সেলিম শুরু থেকেই বামঘনিষ্ঠ। স্নাতকোত্তর করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কলেজ জীবনে সিপিএমের পড়ুয়া সংগঠন এসএফআই-এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। প্রায় এক দশক ছিলেন যুব সংগঠন ‘ডিওয়াইএফআই’-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকও। তার পর কেন্দ্রীয় কমিটি হয়ে ২০১৫-এর বিশাখাপত্তনম পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরোয় স্থান পান।
১৯৯০–য়ে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে পরিষদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ সেলিমের। সেই বছর সেলিমকে রাজ্যসভায় পাঠায় সিপিএম। ২০০১ পর্যন্ত পর পর দু’বার সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য ছিলেন। রাজ্যসভায় সেলিমের বক্তৃতা নজর কেড়েছিল সেই সময় থেকেই। বাংলা, হিন্দি, উর্দু এবং ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারা সেলিম হয়ে ওঠেন দিল্লিতে সিপিএমের অন্যতম চর্চিত মুখ।
২০০১-এ দলের নির্দেশে কলকাতা ফেরা। বিধানসভা ভোটে লড়েন এন্টালি কেন্দ্র থেকে। জেতেন। ৪৪ বছর বয়সে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব পান সেলিম। সেই সময় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল। অলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রবীণ নেতাদের একাংশের দাবি, সেলিমের কার্যপদ্ধতিতে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক। তাই ২০০৪-এ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত সেলিমকে রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
তবে এর কোনও সমর্থন সরকারি বা বেসরকারি— কোনও ভাবেই মেলেনি। এই ধরনের জল্পনা বা দাবির আনুষ্ঠানিক সমর্থন পাওয়াও যায় না। সিপিএমের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়েছিল হিন্দি এবং ইংরেজিতে চোস্ত সেলিমকে জাতীয় রাজনীতিতে আরও বেশি করে কাজে লাগানোই ছিল জাতীয় দল সিপিএমের অভিপ্রায়।
সেই মতো ২০০৪-এর লোকসভা ভোটে কলকাতা উত্তর-পূর্ব আসন থেকে দাঁড় করানো হয়। তৃণমূলের অজিত পাঁজাকে হারিয়ে লোকসভা ভোটে জিতে আবার দিল্লিতে যান সেলিম। এন্টালির উপনির্বাচনে জয়লাভ করেন সিপিএমের আবু সুফিয়ান । সেলিমের দায়িত্বে-থাকা সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর যায় দলের আর এক সংখ্যালঘু মুখ আব্দুস সাত্তারের হাতে। ঘটনাচক্রে, যে সাত্তার এখন সিপিএম ছেড়ে কংগ্রেসে।
২০০৬-এ অনিলের প্রয়াণের পর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ভার বিমান বসু হয়ে গিয়েছিল সূর্যকান্তের হাতে। ২০১১-য় ‘পরিবর্তন’ হয়েছে রাজ্যে। তার পর যত দিন গড়িয়েছে, ভোটের খাতায় সিপিএমের রক্তক্ষরণ বেড়েছে। উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ থেকে লোকসভায় জিতলেও সেখানে হেরেওছেন সেলিম।
তবুও ধারে-ভারে সেলিমই এখন এই ক্ষয়িষ্ণু সিপিএমের অন্যতম পরিচিত মুখ। যে নেতারা সিপিএমের সুসময়ে দল এবং সরকার পরিচালনা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই প্রয়াত। অন্য একাংশ কার্যত বানপ্রস্থে। এই পরিস্থিতিতে সেলিম প্রবীণ-নবীনের ‘সেতু’ হিসেবে কাজ করতে পারবেন বলেই ধারনা আলিমুদ্দিনের। বয়স ৬৫ (ঘটনাচক্রে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে বয়সকে রাজনীতিকদের ‘অবসরের বয়স’ বলে মনে করেন) হলেও সেলিম নেটমাধ্যমে সড়গড়। তাঁর দুই পুত্রের সঙ্গতও তাঁর সঙ্গে সক্রিয় ভাবেই থাকবে। বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে আহুত বিতর্কে অংশ নেওয়ায় সাংবাদিকদের একাংশের সঙ্গেও তাঁর বোঝাপড়া ভাল। যা বিরোধী দলের কাম্য।
তবে প্রবীণ নেতাদের একটা অংশ সমাপতনকে এড়িয়ে যেতে পারছেন না। যে রাজ্য সম্পাদক অনিলের ‘অসন্তোষ’-এর কারণ হয়ে একদা রাজ্য ছেড়ে দিল্লি পাড়ি দিতে হয়েছিল সেলিমকে, দলের কঠিনতম সময়ে সেই সেলিমকেই গিয়ে বসতে হচ্ছে ১৬ বছর আগে অনিলের অকালপ্রয়াণে ছেড়ে-যাওয়া আসনে।
বৃত্ত সম্ভবত এ ভাবেই সম্পূর্ণ হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy