Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

মনুয়া-অজিতের যাবজ্জীবন

বৃহস্পতিবার ওই দু’জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৯ ০৩:১৯
Share: Save:

সাক্ষ্য ৩১ জনের। ৪৭৮ পাতারও বেশি চার্জশিট। ২৬ মাস ধরে চলা অনুপম সিংহ হত্যা মামলায় সাজা ঘোষণা হল শুক্রবার। অনুপমের স্ত্রী মনুয়া মজুমদার ও প্রেমিক অজিত রায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন বারাসত আদালতের চতুর্থ ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক বৈষ্ণব সরকার।

বৃহস্পতিবার ওই দু’জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত। মামলার সরকারি কৌঁসুলি শ্যামলকান্তি দত্ত এ দিন বলেন, ‘‘খুন ও ষড়যন্ত্রের ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছাড়াও দু’জনের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তা অনাদায়ে আরও ১ বছরের অতিরিক্ত কারাবাসের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।’’ ২০১৭ সালের ২ মে বারাসতের হৃদয়পুরে নিজের বাড়িতে খুন হন বেসরকারি সংস্থার কর্মী অনুপম সিংহ (৩৪)। পুলিশি তদন্তে জানা যায়, খুনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মনুয়া ও তার প্রেমিক অজিত। এমনকি, খুনের সময় মোবাইল ফোনে স্বামীর শেষ আর্তনাদও শোনে মনুয়া।

আদালত চত্বরে এ দিন ছিল বিশাল ভিড়। মোতায়েন ছিল পুলিশবাহিনীও। রায়ের পরে আসামিদের ফাঁসির দাবিতে আদালত চত্বরে স্লোগান দিতে থাকেন অনুপমের আত্মীয়-বন্ধুরা। এক জন আইনজীবী এর প্রতিবাদ করায় অশান্তি শুরু হয়। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ আইনজীবীদের সঙ্গে অনুপমের আত্মীয়-বন্ধুদের একাংশের ধাক্কাধাক্কি, পরে মারপিট হয়। শিকেয় ওঠে আদালতের অন্য কাজকর্ম। অবস্থা এমন হয় যে, মনুয়া ও অজিতকে বার করতে গিয়েও বেগ পেতে হয় পুলিশকে। ওই আইনজীবীকে হেনস্থা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁদের মারধর করা হয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেন অনুপমের বন্ধুরাও। পরিস্থিতি সামলাতে নামাতে হয় র‌্যাফ। পরে আটক করা হয় বেশ কয়েক জনকে।

রায় শোনার পরে অনুপম সিংহের বাবা জগদীশ (বাঁ দিকে) এবং মা কল্পনা। শুক্রবার বারাসত আদালত চত্বরে। ছবি: সুদীপ ঘোষ

এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে এজলাসে আনা হয় মনুয়া ও অজিতকে। গোলাপি ওড়নায় মুখ ঢাকা ছিল মনুয়ার। এক ফাঁকে দেখা যায়, চোখ কান্নার জেরে লাল। ডেনিম শার্ট আর ট্রাউজার্স পরা অজিতের মুখও ছিল থমথমে। আদালত শুরু হতেই কাঁদতে থাকে মনুয়া। বিচারক আসামিদের বক্তব্য জানতে চাইলে সে বলে, ‘‘আসল অপরাধী বাইরে। তাকে আড়াল করতে আমাকে সফ্‌ট টার্গেট করা হয়েছে। আমি নির্দোষ।’’ আর অজিত বিচারককে বলে, ‘‘যার জন্য আমি দু’বছর ধরে শাস্তি পাচ্ছি, তাকে আমি চিনিই না। আমি নির্দোষ।’’

সরকারি কৌঁসুলি এর পরে বলেন, ‘‘এই মামলা বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা। অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে রায় দেওয়া হোক। কারণ, অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় এই খুন করা হয়েছে। যিনি খুন হয়েছেন, তিনি নিজেকে বাঁচানোর সুযোগটুকুও পাননি। এই ঘটনা বারাসতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।

কী ভাবে খুন

পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, অজিত রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা জানার পরই অনুপম সিংহের সঙ্গে স্ত্রী মনুয়া মজুমদারের সম্পর্ক খারাপ হয়। খুনের দিন দুপুরে মনুয়া-অজিত অনুপমের বাড়িতে যায়। রাতে অনুপম বাড়ি ফেরার আগে অজিতকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে পিত্রালয়ে চলে যায় মনুয়া। অনুপমের ফোন উদ্ধারের পর জানা যায়, খুনের আগে মনুয়া ও অনুপমের কথোপকথনের বিষয়টি। অনুপমকে ফোন করে তাঁর বাড়িতে ফেরা নিশ্চিত করেছিল মনুয়া। পাশাপাশি, বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অজিতকেও ফোন করে সে সতর্ক করেছিল বলে পুলিশ রিপোর্ট দিয়েছে।

গোটা সমাজ তাকিয়ে আছে এই রায়ের দিকে। দ্বিতীয় বার যেন কেউ এমন ঘটনা না-ঘটাতে পারে, সে জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।’’

মনুয়ার আইনজীবী সুব্রতকুমার মণ্ডল প্রতিবাদ করে বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে মামলার রায় যেন দেওয়া না হয়। সব দিক বিচার করে যেন সাজা ঘোষণা হয়।’’ সরকারি কৌঁসুলি সমাজে প্রভাব পড়ার যে যুক্তি দেন, সে প্রসঙ্গে সুব্রত বলেন, ‘‘এই আদালতেই এক দিন নন্দকুমারের ফাঁসির সাজা দিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। পরে তাঁকে ইমপিচমেন্টের মুখে পড়তে হয়।’’ সব পক্ষের কথা শোনার পর রায় দেন বিচারক। সেই সময় নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কথা বলছিল অজিত-মনুয়া।

রায় ঘোষণার পরেই এজলাসে বসে থাকা অনুপমের মা কল্পনা সিংহ প্রতিবাদ করে কাঁদতে থাকেন। তাঁদের দিকে কড়া ভাবে তাকাতে থাকে অজিত। তা দেখিয়ে বিচারকের উদ্দেশে অনুপমের দিদিরা বলতে থাকেন, ‘‘দেখুন, এখনও কী ভাবে তাকিয়ে আমাদের শাসাচ্ছে।’’ আদালত চত্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনুপমের বাবা জগদীশ চন্দ্র। মা পরে বলেন, ‘‘দু’বছর ধরে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসে ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। আদালত, বাংলাদেশের হাইকমিশনার, নবান্ন, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি সর্বত্রই গিয়েছি। জানি, ছেলেকে আর পাব না। কিন্তু যথাযথ বিচার পেলাম না।’’

অজিতের পরিবারকে এ দিন আদালতে দেখা যায়নি। ছিলেন মনুয়ার মামা পীযূষ দাস। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পরিবার বরাবর এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছে। আদালত যে সাজা দিয়েছে, আমরা মাথা পেতে নিয়েছি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Anupam Singh Manua Majumdar Murder Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy