ধর্মে নেই, জিরাফেও নেই! সিপিএম সম্পর্কে এই ছিল সাবেক ধারণা। পুরনো ছক এ বার ভাঙতে চাইছে তারা। ধর্মের সঙ্গে না-জড়িয়েও ধর্মের অনুষঙ্গে থাকতে চাইছে সিপিএম। লক্ষ্য, আরএসএস-বিজেপির ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির মোকাবিলা করা।
দলের ২৪তম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক খসড়া প্রতিবেদনে এ বার তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপের কথা বলছে সিপিএম। দেশে গত ১০ বছর ধরে চলতে থাকা বিজেপি জমানা এবং সাম্প্রতিক অতীতে নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে হিন্দুত্বের মোকাবিলায় এখন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে প্রকাশ কারাটের দল। আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক ভাবে রুখে দাঁড়ানোই এ বারের পার্টি কংগ্রেসে সিপিএমের মূল মন্ত্র। সেই লক্ষ্যেই কিছু পদক্ষেপের কথা ভাবা হয়েছে। খসড়া রাজনৈতিক প্রতিবেদনে ‘হিন্দুত্বের মোকাবিলা’ শীর্ষক অধ্যায়ের ২.৮০ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে: ‘ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে গিয়ে দলকে কাজ করতে হবে। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার যে এক জিনিস নয়, সেই তফাত তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। উৎসব এবং সামাজিক জমায়েতে বেশি করে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে, যাতে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে সে সবের ব্যবহার না হয়’। বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান আন্দোলনকে জনপ্রিয় করা, ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করার কথাও সেখানে বলা হয়েছে।
ধর্মের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক কী, সেই প্রশ্নে দলের ভিতরে ও বাইরে বহু সময়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। দলের নেতারা নানা সময়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ধর্মাচরণ ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু উৎসবে, অনুষ্ঠানে শামিল হতে দলের তরফে কোনও অসুবিধা নেই। যদিও দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশের কাছে এই ফারাক এমন সূক্ষ্ম যে, বাংলার মতো রাজ্যে দীর্ঘ দিন ধর্মীয় উৎসবের ‘ছোঁয়া’ বাঁচিয়ে চলেছেন তাঁরা। দক্ষিণ ভারতে অবশ্য বামপন্থী নেতারা ধর্মকে ঘিরে উৎসবের আয়োজনে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা, সঙ্ঘ-বিজেপির রাজনীতির দাপটে উৎসব ও সামাজিকতা সংক্রান্ত অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছে দল। ঘটনাচক্রে, আগামী এপ্রিলে সিপিএমের ২৪তম পার্টি কংগ্রেস হতে চলেছে তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ে, যা মন্দির শহর বলেই পরিচিত। এবং জোট-রাজনীতির হাত ধরে তামিলনাড়ুর মতো ধর্ম-প্রধান রাজ্যে শক্তিও বাড়িয়েছে সিপিএম।
পার্টি কংগ্রেসের জন্য তৈরি মোট ৪৪ পাতার রাজনৈতিক খসড়া প্রতিবেদন দলের নানা স্তরে ও বাইরের মতামত নিতে প্রকাশ্যে আসার কথা আজ, শনিবার। বিজেপি যে ভাবে এগোচ্ছে, তার মোকাবিলা করার জন্য সাধারণ মানুষের জনজীবনের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী বহুস্তরীয় প্রচারকে জুড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে রাজনৈতিক প্রস্তাবে। শুধু নির্বাচনী কৌশল নিয়ে যে বিজেপির সঙ্গে এঁটে ওঠা যায় না, তা অবশ্য কারাটের বরাবরের মত।
সাংগঠনিক ভাবে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ার কথা যে দল নিজেরাই স্বীকার করছে, তাদের পক্ষে কি আর ভাবনা বদলে বিজেপির রাজনীতি মোকাবিলা করা সম্ভব? সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? ধর্ম ও উৎসব নিয়ে অনেক বিভ্রান্তিমূলক ধারণা চালু আছে। খুব অভিনব কিছু এখানে বলা হচ্ছে না, অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করা হচ্ছে।’’
রাজনৈতিক স্তরে বিজেপি-বিরোধী জাতীয় ও আঞ্চলিক নানা দলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলার লাইনই বহাল রাখছে সিপিএম। কংগ্রেস মুখে ধান্ধার ধনতন্ত্রের কথা বললেও অর্থনৈতিক প্রশ্নে তারা নব্য উদারনীতিরই পথিক, কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব বিজেপির বিরুদ্ধে আরও কড়া মনোভাব নিচ্ছেন কিন্তু হিন্দুত্বের রাজনীতি মোকাবিলায় দলের মধ্যে এখনও দ্বিধা এবং আপসের প্রবণতা রয়ে গিয়েছে— এই সমালোচনা নিজেদের প্রতিবেদনে রেখেছে সিপিএম। তবে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া রেখে চলার ‘বাস্তবতা’র কথাই বলেছে তারা। যদিও কংগ্রেসের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক জোটে’ তারা যেতে চায় না। বাংলায় দ্বিমেরু রাজনীতি বাঁচিয়ে রাখতে ‘স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত’ তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির বিরোধিতা করে, সিপিএমের প্রতিবেদনে রয়েছে এই মূল্যায়নও।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)