ফাইল চিত্র।
দিঘির জলে ধরা থাকত আকাশের মর্জি। মেঘ থমথমে হলে দিঘিও কালো। আশ্বিনে ভরা দিঘির নীল জল ছলছল করত ঘাটে। শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের মহারাজা যোগেন্দ্রনারায়ণের কাটানো সেই দিঘিগুলি এক এক করে বুজিয়ে বাড়ি, দোকান উঠেছে। তাতে বর্ষার জল বেরোনোর পথ বন্ধ, নিকাশি নিয়েও শুরু হয়েছে সমস্যা। বাসিন্দাদের দাবি, প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। শহরের প্রাণকেন্দ্রে লালগোলা থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পুকুর ভরাট নিয়ে খুব সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার ‘জলাভূমি রক্ষা কমিটি’র পক্ষ থেকে লালগোলা বিএলআরও দফতরে লিখিত অভিযোগজানানো হয়।
রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই মাটি কাটা নিয়ে এমন অভিযোগ ওঠে। উত্তর ২৪ পরগনার শাসন, খড়িবাড়ি, ফলতি, রাজারহাটের মতো এলাকায় বছরের পর বছর মাটি পাচারের কারবার অবাধে চলেছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকায় এমন অনেকে গত কয়েক বছর ধরে খুন হয়েছেন, যাঁদের অনেকেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে মাটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অপরিকল্পিত ভাবে মাটি কাটার জেরে গত বর্ষায় বিদ্যাধরীর পাড় ছাপিয়ে প্লাবিত হয়েছে বিদ্যাধরীর শাখা নদীর আশপাশের গ্রামও। বারাসত জেলা পুলিশের দাবি, বহু চেষ্টার পরে মাটি পাচারের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনা গিয়েছে। স্থানীয় বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আগের পরিস্থিতি যাতে না ফেরে তার জন্য পুলিশকে সক্রিয় থাকতে বলা হয়েছে। চোরাগোপ্তা কিছু হলে, খবর পেলেই আমরা পুলিশকে জানাই। কোনও ভাবেই বেআইনি ভাবে মাটি কাটা বরদাস্ত করা হবে না।’’ জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘বর্তমানে এক মাত্র সরকার মনোনীত সংস্থাগুলিই মাটি কাটার অনুমতি পাচ্ছে।’’
কিন্তু অনুমতি এক বার পেলে, মাটি মাফিয়ারা তা কেমন ভাবে ব্যবহার করে তার উদাহরণ রয়েছে মালদহে। কালিয়াচক ৩ ব্লকের লক্ষ্মীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ভূমি রাজস্ব দফতর গঙ্গাতে এক থেকে দু'মাসের জন্য মাটি কাটার অনুমতি দেয়, কিন্তু দেখা যায় যে পরিমাণ মাটি কাটার কথা, তার অন্তত চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি কেটে পাচার হয়েছে। গত বছর লক্ষ্মীপুরে ভূমি সংস্কার দফতর এবং পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছিল। তার পরেও গঙ্গার জল না বাড়া পর্যন্ত মাটিকাটা চলেছে।
সেই মাটি কী হয়? ইংরেজবাজার শহর সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমি ভরাটের কাজেও নদী থেকে তোলা মাটি ব্যবহার করা হয়। শহরের চাতরা বিল এলাকায় জলাভূমি বুজিয়ে বাড়ি তৈরি হচ্ছে দেদার। কাগজে-কলমে ওই জমির চরিত্রও বদল করা হয়েছে বলে অভিযোগ। মালদহের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি রাজস্ব) শম্পা হাজরা অবশ্য বলেন, ‘‘বেআইনি ভাবে মাটি কাটার অভিযোগ এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রচুর জরিমানা আদায়ও করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি অভিযোগে পুলিশও তদন্ত করে।’’
বহু বছর ধরে পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমায়ও চলে মাটি মাফিয়াদের কারবার। কালিনগর, নতুনচর, কোম্পানিডাঙা, পূর্ব সাতগাছিয়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় চলে অবৈধ এই কারবার। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গভীর রাতে ছোট, বড় বিভিন্ন ট্রলার নেমে পড়ে ভাগীরথীতে। কখনও চাষের জমির মাটিও তারা কেটে নেয় বলে অভিযোগ।
সাধারণত, এক ট্রাক্টরের ট্রলি বোঝাই মাটি বিক্রি হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়। মাটির ব্যবসায় রমরমার কারণ, এই অবৈধ মাটি দিয়ে তৈরি ইটের কম দাম। সরকারি অনুমোদিত ইটভাটাগুলিতে এক একটি ইটের দাম যেখানে ১৬-২০ টাকা, সেখানে অনুমতি নেই এমন ভাটার ইট ১০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। তার বিক্রি দেদার। তাতেই মাটি কাটার ব্যবসাও জমছে। তবে মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল বাকি শেখ বলেন, ‘‘যদি কেউ নিয়ম বহির্ভূত ভাবে মাটি কাটেন, সংগঠন তাঁদের পাশে দাঁড়াবে না।’’
শুধু মাটি কাটাই নয়, বেআইনি ভাবে জমি বিক্রি করে দওয়ার একটা চক্রও কাজ করছে মুর্শিদাবাদে। খোদ তৃণমূলের রানীনগরের বিধায়ক সৌমিক হোসেন সম্প্রতি লালবাগের একটি জমি কেনার প্রস্তাব পান। সৌমিক বলেন, ‘‘খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, তা নবাব এস্টেটের জমি। যা সাধারণ মানুষকে বিক্রি করা যায় না।’’ সৌমিকের বক্তব্য, ‘‘যদি আমাকেই ঠকানোর চেষ্টা হয়, তা হলে তলে তলে কী হচ্ছে, ভেবে শিউরে উঠছি।’’ মুর্শিদাবাদ জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, ‘‘জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া বা বেনামে জমি বিক্রি করে দেওয়া এবং অবৈধ ভাবে বিএলআরও-তে রেকর্ড পরিবর্তন করার অভিযোগ যদি নির্দিষ্ট ভাবে আমাদের কাছে আসে, কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy