নৈহাটিতে বাজির মশলা এবং রাসায়নিক নিষ্ক্রিয় করার সময়ে বিস্ফোরণের নানা মুহূর্ত। নিজস্ব চিত্র
প্রথমে বিকট আওয়াজ। তার পরেই আকাশে উঠল আগুনের বিরাট গোলা। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাতার মতো আকার নিল। ঝনঝনিয়ে ভাঙল অনেক বাড়ির কাচ, ফাটল ধরল দেওয়ালে। টিনের বাড়ির ছাদ উড়ে গিয়ে পড়ল দূরে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটির গঙ্গাপাড়ের গৌরীপুরের ঘটনা। পুলিশের বাজেয়াপ্ত করা বাজির মশলা এবং রাসায়নিক নিষ্ক্রিয় করতে ঘটানো ওই বিস্ফোরণে সেখানকার আটটি বাড়ির দেওয়াল ও ছাদ ফেটে যায়। কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় সেগুলি। অভিঘাত পৌঁছয় চুঁচুড়াতেও। চুঁচুড়ার গঙ্গার ধার বরাবর তিনটি ওয়ার্ডের একের পর এক বাড়ির দেওয়ালে ফাটল ধরে। ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে জানলা-দরজা, আলমারি, শোকেসের কাচ। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন দু’দিকেই। আতঙ্কিত মানুষ পরে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। গৌরীপুরে পুলিশকে মারধর করে তাদের দু’টি গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হয় অবরোধও। ফলে, পুলিশ এবং দমকলের গাড়ি দীর্ঘক্ষণ ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি। দমকলকর্মীদের হেনস্থাও করা হয় বলে অভিযোগ। চুঁচুড়াতেও অবরোধ হয়। পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভও চলে।
বারাসতে যাত্রা উৎসবের উদ্বোধন করতে গিয়ে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার কথা শুনে নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিককে ঘটনাস্থলে পাঠান। তিনি বলেন, ‘‘বিস্ফোরণে অনেক বাড়িতে নাকি ফাটল ধরেছে। তা হয়ে থাকলে প্রশাসন সব রকম সাহায্য করবে। একটা কাজ করতে গিয়ে যদি কারও ক্ষতি হয়, তা দেখার দায়িত্ব আমাদের। আমরা নিশ্চই দেখব।’’ আজ, শুক্রবার থেকেই ক্ষয়ক্ষতির সমীক্ষা শুরু হবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। নৈহাটির পুরপ্রধান অশোক চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত সব বাড়িই তাঁরা দেখে এসেছেন। শুক্রবার থেকেই সেগুলির মেরামতি শুরু হবে।
আরও পড়ুন: পড়ুয়াদের সামনে রেখে এবার নাগরিকত্ব আন্দোলন মমতার
পুলিশ জানিয়েছে, সিআইডি-র ‘বম্ব স্কোয়াড’ বাজির মশলা নষ্ট করছিল। সেই সময় অসাবধানে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এমন ঝুঁকির কাজ বম্ব স্কোয়াড কেন দায়সারা ভাবে করল সে প্রশ্ন উঠেছে। বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি মানা হয়েছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখছে নবান্ন। নবান্নের কর্তারা মনে করছেন, বিস্ফোরণের তীব্রতা আঁচ করার ক্ষেত্রে কিছু খামতি থেকে থাকতে পারে। যদি একসঙ্গে সব বিস্ফোরক নষ্ট না করে সেটিকে আলাদা আলাদা ভাবে ভিন্ন স্থানে নিষ্ক্রিয় করা হত, তা হলে এই তীব্রতা মালুম হত না। মানুষের মধ্যে অযথা আতঙ্কও তৈরি হত না। পুরো বিষয়টি নিয়ে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের কাছে রিপোর্ট চেয়েছে নবান্ন।
বিস্ফোরণের তীব্রতা দেখে অনেকেরই প্রশ্ন, কেন নদীতে ফেলে বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করা হল না? এটা কি শুধুই আতসবাজির বিস্ফোরক, না কি অন্য কিছুও ছিল? বিরোধীরা এই প্রশ্নে এনআইএ তদন্তেরও দাবি করেছে।
আরও পড়ুন: বোমা-শিল্প চলছে, বিরোধী তোপে রাজ্য
নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন, কোনও ধরনের বিস্ফোরকই নদী বা জলাশয়ে ফেলে নিষ্ক্রিয় করা হয় না। তা হলে ওই এলাকায় জলদূষণের তীব্রতা বেড়ে যায়। মাছ-সহ জলজ প্রাণীর ক্ষতি হতে পারে। সেই কারণেই গঙ্গায় বিস্ফোরকগুলি ফেলা হয়নি। তা ছাড়া, আতসবাজির বিস্ফোরক বলেই বিস্ফোরণের সঙ্গে এত আলো দেখা গিয়েছে। আইইডি-তে ব্যবহৃত বিস্ফোরকের ক্ষেত্রে কালো ধোঁয়া হত। বিস্ফোরণের মাত্রা আরও ভয়াবহ হত। আলো ততটা দেখা যেত না। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘এখনও বড়সড় কোনও তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি এখন খতিয়ে দেখছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি।’’
গত শুক্রবার নৈহাটির দেবকে একটি অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে পুড়ে মৃত্যু হয় পাঁচ জনের। তার পরে নৈহাটির সব বাজি কারখানা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। গত কয়েক দিনে পুলিশ বাজি কারখানাগুলি থেকে বেশ কয়েক কুইন্টাল বাজির মশলা এবং রাসায়নিক বাজেয়াপ্ত করে। সে সবই গত দু’দিন ধরে গঙ্গার ধারে নষ্ট করা হচ্ছিল। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তার ফলে ওই এলাকা ঘন ঘন কেঁপে উঠছিল। তবে সে শব্দের তীব্রতা এ দিনের মতো ছিল না। এ দিনের বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, এক কিলোমিটার দূরের বাড়িতেও ভেঙে পড়েছে জানলা-দরজার কাচ। আতঙ্ক ছড়ায় দু’পাড়ে।
গৌরীপুর জুটমিল এলাকার বাসিন্দা শ্যাম রজক বলেন, ‘‘এমন শব্দ আমি কখনও শুনিনি। খাটে বসেছিলাম। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল। আমার টিনের চাল উড়ে গেল। নামতে গিয়ে আমি খাট থেকে পড়ে গেলাম। কোনও রকমে উঠে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল, ঘরের এক দিকের দেওয়াল ভেঙে পড়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy