জেলা পুলিশের সদর দফতর।
হাঁসের প্রিয় গুগলি
পর্তুগিজদের হুগলি
গুণের প্রিয় তানপুরা
ওলন্দাজদের চিনসুরা।
ইতিহাসের শহর চুঁচুড়া নিয়ে কবি অন্নদাশঙ্কর রায় এক সময় এই ছড়া লিখেছিলেন। গঙ্গাপাড়ের এই জেলা শহরের আনাচে কানাচে ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজদের সময়কার নানা ইতিহাস যেমন এই শহরে রয়েছে তেমনিই রয়েছে ব্রিটিশ শাসনকালের নানা স্মারক। রয়েছে রাজা জমিদারের রোম খাড়া করা নানা কাহিনি।
চুঁচুড়া শহরে পর্তুগিজদের এক সময় বন্দর ছিল। যা বক্স বন্দর হিসেবেই পরিচিত ছিল সেই সময়। ১৬৩২ সালে নাগাদ চুঁচুড়ার একাংশ কুলিহান্ডা নামে পরিচিত ছিল। সেখানে কায়িক পরিশ্রম করে যাঁরা রোজগার করতেন মূলত তাঁরাই বাস করতেন। সেই থেকেই জায়গাটি কুলিহান্ডা নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। চুঁচুড়ায় গঙ্গার পাড়ে মূলত জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতেন। ডাচেরা সেই আমলে ১৪টা প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করেছিলেন চুঁচুড়ায়। চিত্রকলার ক্ষেত্রেও তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। যা সেই আমলে ডাচ বেঙ্গল চিত্রকলা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। স্থানীয় পটুয়াপাড়ার শিল্পীদের তাঁরা কাজে লাগিয়েছিলেন।
বন্দেমাতরম ভবন।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত দত্ত লজ।
ইতিহাসের পাশাপাশি সাহিত্যেও যথেষ্ট ঐতিহ্যশালী এই শহর। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দেবেন্দ্রনাথ এসেছিলেন চুঁচুড়ার দত্ত ভিলায়। তারপর থেকে বাবার সূত্রে এই শহরে বার বার পা রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির লেখা গান, কবিতার নানা স্মৃতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে এই প্রাচীন শহরের। চাকরির সুবাদে উত্তর ২৪ পরগনার কাঁঠালপাড়ার নিজের বাড়ি থেকে নৌকা পেরিয়ে এ শহরে আসতেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর সাহিত্যে, আড্ডায় মজে এক সময় এই শহরের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন। চুঁচুড়ার জোড়াঘাটের বন্দে-মা-তরম ভবন আজও তাঁর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
সাহিত্যের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই শহরের জুড়ি মেলা ভার। শহরের কনকশালি এলাকায় বাস করতেন রামরাম বসু। তাঁর লেখা প্রতাপাদিত্য চরিত্র বাংলা সাহিত্যর ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রাচীনতম। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭৬ সালে হাওড়া থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসেন চুঁচুড়া কালেক্টরেটে। পরে এটাই পাকাপাকি বাস হয়ে যায় তাঁর। বন্দেমাতরম ভবনের পরিদর্শক সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বঙ্কিমচন্দ্রের শহরে বাস করার সুবাদে রীতিমত মজলিশ বসত প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের।” সেইসব মজলিশে কে ছিলেন না? থাকতেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামগতি ন্যায়রত্ন, কবি অক্ষয়চন্দ্র সরকার, কবি দীননাথ ভড়দের মতো মানুষ। রামগতি ন্যায়রত্ন বাংলা ভাষার প্রথম ইতিহাস লেখেন।
শহরের মোড়ে বিখ্যাত ঘড়ি।
জেলা সদর চুঁচুড়ার বড়বাজার এলাকায় গঙ্গার ধারে রয়েছে ঐতিহাসিক দত্ত লজ। বাড়ির মালিক ছিলেন কলকাতার সেই সময়ের বড় ব্যবসায়ী মাধব দত্ত। তাঁর চুঁচুড়ার বাগান বাড়িটি ছিল গঙ্গার পাড়ে মনোরম পরিবেশে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধুত্বের সুবাদে ১৮৭৯ সালে ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারে মহর্ষি পরিবার পরিজন নিয়ে এই বাগানবাড়িতে ওঠেন। সেই শুরু। পরে বাবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও সেখানে এসেছিলেন বারে বারেই। বাড়িটি সেই সময় ঠাকুরবাড়ির বাগান বাড়ি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিল। যদিও তারই মাঝে বহুবারই বাড়ির মালিকানার হাতবদল হয়। আজও গঙ্গার পাড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে দত্ত লজ।
এ হেন ইতিহাসের শহরে এখন ইতিহাসই অবহেলিত। এমনটাই অভিযোগ শহরের প্রবীণ বাসিন্দাদের। প্রকৃত অর্থেই হেরিটেজের এই শহরে সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা নেই। যদিও পুরসভার তরফে একটি হেরিটেজ কমিটি রয়েছে। শহরের ইতিহাস ও ঐহিত্যকে ধরে রাখার প্রশ্নে সেই কমিটির সদস্যরা নানা প্রস্তাবও দিচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেন কোথাও একটা শিথিলতা রয়েছে। পুরপ্রধান গৌরীকান্ত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শহরের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছি। আমাদের যে কমিটি রয়েছে তাতে অনেকে বিশেষজ্ঞও রয়েছেন।” কমিটির সদস্য হেরিটেজ নিয়েই গবেষণারত রেশমী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা হুগলি-চুঁচুড়া শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে এমন সব স্মারকের তালিকা তৈরি করেছি। স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই নিয়ে সচেতনা বাড়াতে নানা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হচ্ছে।”
ইতিহাসের শহর নিয়ে গর্বিত চুঁচুড়ার প্রবীণ বাসিন্দাদের অবশ্য আক্ষেপও রয়েছে। তা হল, ঘড়ির মোড়, ডাচ সিমেট্রি, ইমামবাড়া, সাতবিবির গোড়ের মতো সমৃদ্ধি রয়েছে যে শহরে, সেখানে প্রশাসন কী আরও আগে থেকে এ সব সংরক্ষণে আরও যত্নবান হতে পারত না?
ছবি: তাপস ঘোষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy