সুনসান: ফাঁকা গোন্দলপাড়া মিল চত্বর। ফাইল ছবি
দূরশিক্ষায় হিন্দি অনার্স পড়ছেন রাহুল ঠাকুর। চনমনে যুবকটি এখন কেমন থম মেরে থাকেন! পাড়ার মাঠের ক্রিকেট তাঁকে আর টানে না। প্রৌঢ় রাম দাস ভাবেন, কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে ভাল হত! নন্দিনী দাসের বিয়ে হয়েছিল মাস ছ’য়েক আগে। এর মধ্যেই স্বামী গলায় দড়ি দিলেন। যে দিন স্বামীর শ্রাদ্ধ, সে দিন চোখের জল মুছতে মুছতে যুবতী ছুটেলেন শহরের অন্য প্রান্তে। একটি সংস্থা থেকে আর্থিক সাহায্য আনতে। ওইটুকু টাকা দরকার ছিল সংসারে।সংসার খরচ, নিজের চিকিৎসা, মেয়েদের পড়া— সব কী ভাবে চলবে সেই চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না নির্মল চৌধুরীর।
গোন্দলপাড়া চটকলের শ্রমিক মহল্লার আনাচে-কানাচে মনখারাপের এমন টুকরো টুকরো ছবি ধরা পড়ে। কেননা, এক বছর আট মাস ধরে চটকল বন্ধ। রোজগার হারিয়ে দিশাহীন শ’য়ে শ’য়ে শ্রমিক। তারই ছাপ তাঁদের মনে! নির্মল, রাম, রাহুলের বাবা চন্দননগরের বন্ধ ওই চটকলের শ্রমিক। নন্দিনীর স্বামী, বছর পঁচিশের শ্যামা দাস তাঁদের সহকর্মী ছিলেন।
‘হতাশাগ্রস্ত’ এই সব শ্রমিক পরিবারের লোকজনকে মানসিক ভাবে শক্তি জোগাতে উদ্যোগী হয়েছে চন্দননগরের নাগরিক সমাজ। আজ, বুধবার তারা সেখানে গিয়ে তাঁদের মনের খোঁজ নেবে। তাঁদের বোঝাবে, কেউ যেন আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত না নেন। জীবন যাপনের জন্য যেন লড়াই চালিয়ে যায়। এর পাশাপাশি নিখরচায় স্বাস্থ্য শিবির হবে। উদ্যোক্তাদের তরফে বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, মিল বন্ধের পরে অভাবের েজরে অবসাদে ভুগে ছ’জন শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন। তার মধ্যে গত ছ’মাসেই চার জন। তিনি বলেন, ‘‘ওখানে চরম সঙ্কট। লোকে কাজ পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইএসআই-এর সুবিধা না মেলায় চিকিৎসাও হচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই হতাশা গ্রাস করছে। মানসিক ভাবে শক্তিশালী না হলে এই মৃত্যু মিছিল বাড়বে। তাই সমস্যা বুঝে মনোবিদ কাউন্সেলিং করবেন।’’
বছর কয়েক আগে খড়্গপুর আইআইটি-র মনস্তত্ত্ব বিভাগের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, সুপার সাইক্লোনের জেরে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনের মধ্যে তার প্রভাব পড়েছে। অনেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রেও মিল বন্ধের কারণে এমন কিছু হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে অনেকেই মনে করছেন।
বিশ্বজিৎবাবু জানান, মনোবিদের পাশাপাশি সাধারণ রোগ, স্ত্রী-রোগ, অর্থোপেডিক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা করবেন। মিল না খোলা পর্যন্ত প্রতি মাসে এই শিবির করার চেষ্টা করা হবে। এলাকার প্রাক্তন ফরওয়ার্ড ব্লক কাউন্সিলর রাজেশ জয়সোয়ারা ওই চটকলেরই শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই হতাশায় ভুগছেন। ঘুম থেকে উঠে ভাবি, আজ কারও মৃত্যুর খবর শুনতে হবে না তো!’’
রাম দাসের চার মেয়ে। এক জন দূরশিক্ষায় বিএ পড়ছেন। এক জন মাধ্যমিক দেবে। এক জন একাদশ এবং অপর জন নবম শ্রেণিতে পড়ে। রামের কথায়, ‘‘জোগাড়ের কাজ করছি। রোজ কাজ মেলে না। পয়সা বাঁচাতে চন্দননগর থেকে ব্যান্ডেলে সাইকেল চালিয়ে যাই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে এখন মাছ-মাংসের কথা ভাবতে পারি না। আনাজের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাও বন্ধ। শুধু ডাল আর আলুর তরকারি দিয়ে ভাত খাই।’’ তিনি বলেন, ‘‘রোজগার না থাকলে যা হয়, প্রায়ই বাড়িতে ঝগড়া হয়য়। ভাবি, সব ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই। মেয়ে-বৌয়ের কথা ভেবে পারি না। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন!’’
শ্রমিকদের অভিযোগ, দুশ্চিন্তার কারণেই নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন তাঁরা। চিকিৎসার অভাবে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নির্মল চৌধুরী ছোটখাট কাজ করে কোনওরকমে সংসার চালাচ্ছিলেন। সম্প্রতি তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। নীলরতন সরকার হাসপাতালে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসায় প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। অপরের সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা হল। না হলে বাঁচতামই না। ডাক্তার তিন মাস বিশ্রাম লিখেছেন। এখন খাব কি? আত্মীয়, বন্ধুদের সাহায্যেই চলছে। এর পরে কী হবে? চিন্তায় ঘুম আসে না।’’ নির্মলের তিন মেয়ের মধ্যে এক জনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মেজ মেয়ে মনিশা দূরশিক্ষায় বিএ পড়ছেন। ছোট মেয়ে মধূ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। বাবার আক্ষেপ, চিন্তায় মেয়েরাও পড়ায় মন দিতে পারছে না।
উনিশ বছরের রাহুল ঠাকুর বলেন, ‘‘বাবা সেলুনে কাজ করছেন। প্রতিদিন সমান রোজগার হয় না। কোনওরকমে আমাদের চলছে। খুব মন খারাপ করে। এখন আর খেলতে বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেও ইচ্ছে করে না। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিছু একটা কাজ পেয়ে গেলে বাঁচি। না হলে এই দুশ্চিন্তা শেষ হওয়ার নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy