Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
West Bengal Lockdown

কাজ নেই, বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন নৌ-শিল্পীরা

নোটবন্দি এবং জিএসটি-র ধাক্কায় আগে থেকেই নড়বড়ে অবস্থা ছিল ছোট শিল্প-কারখানার। লকডাউনে এসে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। মালিকেরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকছে শ্রমিকদের। কবে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি, তার কোনও দিশা দেখতে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরাও। কেমন আছেন ওই সব শিল্প-কারখানার শ্রমিক-মালিকেরা? খোঁজ নিল আনন্দবাজার।কবে করোনাভাইরাস বিদায় নিয়ে তাঁদের ‘বর্ষা’ নামবে, সেটাই একমাত্র প্রার্থনা নৌকা কারখানার মালিক থেকে কারিগরদের।

নৌকা কারখানায় কাজ বন্ধ বলাগড়ের গ্রামে

নৌকা কারখানায় কাজ বন্ধ বলাগড়ের গ্রামে

প্রকাশ পাল
বলাগড় শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২০ ০৩:১৩
Share: Save:

ক্যালেন্ডার বলছে, আর মাসখানেক পরে বর্ষা। অথচ, শেখ নাসিমের মন ভাল নেই। সুন্দরবনের গ্রামে তাঁর পাঁচ-পাঁচটা নৌকা বুঝি রোদে-জলে নষ্টই হয়ে গেল!

বলাগড়ে বাড়িতে বসে সেই চিন্তায় ঘুম উবে যাওয়ার জোগাড় তেত্রিশ বছরের যুবকের। বলাগড়ে নৌ-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বাকিদেরও রাতের ঘুম কেড়েছে লকডাউন। কবে করোনাভাইরাস বিদায় নিয়ে তাঁদের ‘বর্ষা’ নামবে, সেটাই একমাত্র প্রার্থনা নৌকা কারখানার মালিক থেকে কারিগরদের।

এখানকার শ্রীপুর, তেঁতুলিয়া, রাজবংশীপাড়া, চাঁদরার মতো এলাকায় অনেক পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এখানকার তৈরি নৌকা রাজ্যের বিভিন্ন খাল-বিল, নদীতে ভেসে বেড়ায়। এখান থেকে নৌকা এক সময় ভিন্‌ রাজ্যেও যেত। সেই সময় চল্লিশের বেশি কারখানা ছিল। নানা কারণে শিল্পে মন্দা দেখা যায়। তবে এখনও ১৬-১৭টি কারখানা রয়েছে। কারবারিরা জানান, বলাগড়ে নৌকা তৈরি হয় মূলত বাবলা কাঠ দিয়ে। কম দামি কাঠেও নৌকা বানানো হয়। আকার অনুযায়ী নৌকার দাম হয়। কাকদ্বীপ, রায়দিঘি, বকখালি-সহ নানা জায়গা থেকে মৎস্যজীবীরা নৌকা কেনেন। বর্ষায় চাহিদা বাড়ে। সেই কারণে বৈশাখ মাস থেকে কারখানায় নৌকা মজুত করতে শুরু করেন কারবারিরা।

এ বার পরিস্থিতি ভিন্ন। রাজবংশীপাড়ার একটি কারখানার মালিক কালীপদ বারিক জানান, বাবলা কাঠ আসে নদিয়ার করিমপুর, তেহট্ট এবং বাঁকুড়া থেকে। লকডাউনে কাঠ আসা বন্ধ। কাজও বন্ধ। স্থানীয় পাঁচ জন শ্রমিক তাঁর কারখানায় কাজ করেন মজুরির ভিত্তিতে। কাজ বন্ধ থাকায় তাঁরা সমস্যায়। চলার মতো কিছু টাকা তিনি দিয়েছেন শ্রমিকদের। কালীপদবাবু ‘বলাগড় নৌ-শিল্পী সমিতি’র সম্পাদকও। তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত পরিস্থিতি না শুধরোলে শ্রমিকদের খুব সমস্যা হবে।’’

শেখ নাসিম জানান, তাঁর বাবার নৌকা তৈরির কারখানা ছিল। পুঁজির অভাবে সেটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নাসিম অন্যত্র নৌকার কারিগর হিসেবে কাজ করতেন। টাকা জমিয়ে এবং বন্ধুর সহায়তায় বছর আটেক আগে তিন‌ি ফের কারখানা চালু করেন। তিনি বলেন, ‘‘কাজের সূত্রে সুন্দরবনে গিয়ে নৌকা বিক্রি করি। মাস দেড়েক আগে ওখানে পাঁচটা নৌকা পাঠিয়েছি। কিন্তু করোনা নিয়ে ডামাডোলে নিজে যেতে পারিনি। নৌকাগুলো ওখানে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। বেচতে পারব কিনা সন্দেহ। কিছু দিন আগেই ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বাড়ির একটা গরু বেচে ব্যবসায় ঢুকিয়েছিলাম। সেটাও বোধহয় গেল! ডাহা লোকসা‌ন। আমার স্নায়ুরোগ আছে। স্ত্রীও অসুস্থ। কী করব, ভেবে পাচ্ছি না। পরিস্থিতি খুব খারাপ।’’

চাঁদরার বাসিন্দা রামপ্রসাদ হালদার কিশোর বয়স থেকে নৌকা তৈরির কাজে যুক্ত। তখন দৈনিক মজুরি ছিল ৫০ পয়সা। এখন তিনি সাতান্ন। সারাদিন খেটে এখন পান আড়াইশো টাকা। তাতেই ‘সংসার-তরী’ এগোয়। লকডাউনে উপার্জনও বন্ধ। তিনি জানান, সরকারি সাহায্য বলতে মাথাপিছু দু’কিলো চা‌ল। পঞ্চায়েতের তরফেও কিছু চাল দেওয়া হয়েছে। কারখানা-মালিক হাজার দুয়েক টাকা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘চালের সঙ্গে আনাজ, মশলাপাতিও তো লাগে। গাছের কাঁচা আম, নারকেল বেচলাম। নৌকা তৈরির পরে কিছু ছাঁট কাঠ বাঁচে। তাও বেচলাম। তাতেও তো চলছে না!’’

প্রৌঢ় জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে ভাতের সঙ্গে মেনুতে ছিল আলু, পাটশাক দিয়ে মুসুর ডাল। মাছের কথা ভাবা মানে স্বপ্ন দেখা।’’ অভিজ্ঞ শ্রমিক বলে ওঠেন, ‘‘লকডাউন উঠলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে? নৌকা কেনার সামর্থ্য গরিব মৎস্যজীবীর থাকবে? মালিকের অবস্থাও তো আহামরি নয়। কী হবে, ভেবে পাচ্ছি না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Lockdown Boat Balagarh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy