শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতাল যখন রাজ্য সরকার ‘কোভিড হসপিটাল’ হিসাবে সাময়িক ভাবে অধিগ্রহণ করে, তখন সেখানে কর্মরত নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী বন্ধুদের মনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, স্ট্রেস সামাল দিতে যাচ্ছিলাম। জানতাম না, আমাকে সংক্রমিত হয়ে এখানেই ভর্তি হতে হবে!
সম্প্রতি কী ভাবে সংক্রমিত হয়েছিলাম জানি না! পথেঘাটে, পেশাগত কাজের জায়গায় যতটুকু সতর্কতা মেনে চলা উচিত ছিল, জ্ঞানত সেই চেষ্টা করেছি। কোথাও হয়তো অসচেতনতার ফাঁক ছিল!
প্রথম যে দিন জ্বর আসে, সে দিনই চিকিৎসক-বন্ধুর পরামর্শে ওষুধ শুরু করি। সঙ্গে ফুটন্ত জলে নুন দিয়ে ভাপ নেওয়া আর হালকা গরম জল বা লিকার চা খাওয়া। যদিও গলা ব্যথা, সর্দি-কাশি ছিল না। ধীরে ধীরে খাওয়ার রুচি চলে গেল। জ্বর তৃতীয় দিনে বাড়ল। লালারসের নমুনা নেওয়া হল। শ্রমজীবী হাসপাতালের চিকিৎসক কুণাল দত্ত পরীক্ষা করে জানালেন, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বেশ কম। অতঃপর সম্ভাব্য কোভিড রোগী হিসেবে ব্যান্ডেল ইএসআই হাসপাতালে ভর্তি হলাম। কোভিড-পজ়িটিভ হল।
স্থানান্তরিত হলাম শ্রমজীবী হাসপাতালের আইসিইউ-তে। পরিচর্যায় দ্রুত সুস্থ হলাম। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর যত্ন মনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাকে অনেকখানি প্রশমিত করে। সব রোগীর ক্ষেত্রেই একই পরিচর্যা চাক্ষুষ করেছি।
কোভিড রোগীদের অনেকেরই ‘কো-মর্বিডিটি’ বা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। বিশেষ করে, যাঁরা পঁয়ষট্টি পেরিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ব্লাড সুগার, হাই-প্রেশার, হাইপোথাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে, এমনও কয়েক জন ছিলেন। প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সুতরাং, ‘কো-মর্বিডিটি’ থাকলেই যে কোভিডে জীবন বিপন্ন, এমন নয়। তা বলে ঝুঁকি নেই, তাও নয়! সেই কারণেই বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে প্রতিবেশীরা কুশল জিজ্ঞেস করতে এগিয়ে এসেছেন। আমার কোভিড হওয়ায় বাড়ির সবাই যখন ‘কোয়্যারান্টিন’-এ, তখন জিনিসপত্র কিনতে তাঁরাই সাহায্য করেছেন। বাড়ির কেউ আমার দ্বারা সংক্রমিত হননি, হয়তো সতর্কতা মেনে চলার কারণেই!
আমাদের নানা অজ্ঞতা, ভ্রান্ত ধারণার জেরে করোনা-সংক্রমণ, আক্রান্ত ব্যক্তি, তাঁদের পরিবার বা সংক্রমিতের মৃতদেহকে অস্পৃশ্য করে তুলেছে। সতর্কতা সত্ত্বেও যে কেউ সংক্রমণের শিকার হতে পারেন। লক্ষণ থাকলেই করোনা সংক্রমণ, এমন নাও হতে পারে। প্রথমেই জরুরি, আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে যোগাযোগ করা। সন্দেহ হলে সরকারি হাসপাতাল বা বেসরকারি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করানো যেতে পারে।
করোনা-আক্রান্ত হলেই জীবন বিপন্ন, এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাড়িতে বা প্রতিবেশী কেউ আক্রান্ত হলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, প্রয়োজনীয় সুরক্ষা-সতর্কতা নিয়ে তাঁর পাশে থাকতে হবে। তাঁর অসুবিধা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। তাঁর অনুভূতিকে তাঁর জায়গা থেকে অনুভবের চেষ্টা করতে হবে। আমরা যে স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক জীব নই, পারিবারিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে, এটা যেন না ভুলি! তাঁদের একঘরে করার কিংবা সামাজিক বিড়়ম্বনার মধ্যে ফেলার অপচেষ্টা হলে রুখে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সংক্রমণের শিকার আমিও হতে পারি।
যে কোনও ভাইরাসের মোকাবিলায় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে ঠিক থাকে এবং মন সুস্থ থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন সুষম খাবার, বিশেষ করে ভিটামিন-সি আছে, এমন খাবার, পর্যাপ্ত জল খাওয়া দরকার।
অতিরিক্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়, এমন অনুষ্ঠান বা খবর দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। একটু গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম অভ্যাস করা, মনের কথা মন খুলে বলে একটু হালকা হতে চেষ্টা করা— শরীর-মনকে ভাল রাখতে এগুলো করা যায়।
বর্তমানে সংক্রমণ দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। এই সময়ে আমরা চেষ্টা করি অপ্রয়োজনে বাইরে না-বেরোতে এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা-সতর্কতার অভ্যাসগুলো যতটা সম্ভব মেনে চলতে। তা হলেই সামাল দেওয়া যাবে করোনা ভাইরাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy