প্রতিবাদ: ভাটিতে মহিলাদের অভিযানের একটি মুহূর্ত। ফাইল ছবি
গ্রামের বুক চিরে চলে গিয়েছে গুজারপুর খাল। পাঁচ বছর আগেও উলুবেড়িয়া-২ ব্লকের তুলসিবেড়িয়া গ্রামের এই খালের পাশ দিয়ে গেলে চোলাইয়ের ঝাঁঝালো গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিতে হত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এই গ্রামে আর একটাও চোলাইয়ের ভাটি নেই। যাঁরা ভাটি চালাতেন তাঁরা এখন দিনমজুরি করেন। পাশের গ্রাম আমতা-১ ব্লকের খড়দহেও চলত ভাটি। তুলসিবেড়িয়া ও খড়দহ মিলিয়ে গুজারপুর খালের ধারে ৬০টি ভাটি ছিল। বছর পাঁচেক হল সব ভাটি বন্ধ। খুশি এলাকার বাসিন্দারাও।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খালের দু’পাশে চোলাইয়ের ভাটির বর্জ্য পড়ে খালের জল দূষিত হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ বংশানুক্রমে সেই ভাটি চালাতেন। কিন্তু এলাকার কয়েকজন মহিলা এই চোলাইয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। প্রায় ১০ বছর ধরে চলে লাগাতার আন্দোলন। ফল, গ্রাম এখন চোলাই-ভাটিমুক্ত।
চোলাই খেয়ে গ্রামের পরিবারে অশান্তির কথা স্পষ্ট মনে রয়েছে সকলের। এই গ্রামেরই গঙ্গা দলুইয়ের স্বামী মোহন এবং ভাসুর শীতল চোলাই খেয়ে মারা যান। গঙ্গাদেবী বলেন, ‘‘ঘরে ঘরে তখন চোলাই তৈরি হচ্ছে। ফলে মদ জোগাড় করতে অসুবিধা হত না। কত নিষেধ করেছি। কিন্তু শুনলে তো!’’ দুর্গা দলুই নামে তুলসিবেড়িয়ার বাসিন্দা এক মহিলা বলেন, ‘‘আমার কয়েকজন আত্মীয় চোলাই খেয়ে বাড়ির মেয়েদের উপর কী অত্যাচার করত!’’
চোলাই খেয়ে মৃত্যুর ঘটনার পরই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান গ্রামের মহিলারা। নেতৃত্ব দেন দুর্গাদেবীই। সঙ্গে পেয়ে যান বহু মহিলাকে। সেই সময় পাশের গ্রাম কামিনায় দুই বাসিন্দা মন্টু শী এবং কল্যাণী পালুইয়ের নেতৃত্বে চলছে চোলাই বিরোধী আন্দোলন। তাঁদের কাছে গ্রামের মহিলাদের নিয়ে যান দুর্গাদেবী। মন্টুবাবু এবং কল্যাণীদেবীর উদ্যোগে গড়া হয় মহিলা সমিতি, যার নেতৃত্বে ছিলেন দুর্গাদেবী। সমিতির উদ্যোগে তুলসিবেড়িয়া এবং খড়দহ গ্রামেও শুরু হয় চোলাই বিরোধী অভিযান।
দুর্গাদেবী বলেন, ‘‘প্রথমে বাধা পেয়েছিলাম। আমাদের মারধর করা হয়।’’ মন্টুবাবু বলেন, ‘‘আমরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পুলিশ চোলাই ভাটির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও ভাটি বন্ধ করা যাচ্ছিল না।’’ শেষ পর্যন্ত এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত লোকজনকে বোঝানো শুরু হয়। মন্টুবাবু বলেন, ‘‘দুটি গ্রামের মহিলাদের নিয়ে আমরা প্রতি সপ্তাহে বৈঠক করতাম। তাঁদের নিয়ে ভাটি মালিকদের কাছে যেতাম। তাঁদের বোঝাতে থাকি, ভাটি চলার ফলে গ্রামের বদনাম হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কাজ হয়। ধীরে ধীরে ভাটি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা এখনও নজর রাখি। তবে পাঁচ বছর হল ভাটি আর খোলেনি।’’
ভাটি চালাতেন সন্ধ্যা দলুই নামে গ্রামেরই এক মহিলা। তিনি বলেন, ‘‘মহিলা সমিতির চাপে পড়ে ভাটি বন্ধ করেছি। দিনে চারশো টাকা রোজগার করতাম। সেটা বন্ধ। ছেলেদের টাকায় সংসার চলে। তবে ভাল আছি।’’ ভাটি চালিয়ে দিনে সাতশো টাকা রোজগার করতেন বিশ্বনাথ দলুই। তিনি বললেন, ‘‘ভাটি বন্ধ। এক ছেলেকে অটো কিনে দিয়েছি। এক ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। আমি দিনমজুরি করি। রোজগার হয়তো কমেছে। তবে তবে লজ্জা, হয়রানির হাত থেকে বেঁচেছি।’’
তবে প্রশাসনের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ রয়েছে ভাটি মালিকদের। সন্ধ্যাদেবী বলেন, ‘‘এতগুলি মানুষ রোজগার হারালাম। অথচ আমাদের বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা করা হল না। ব্যবসা করার জন্য ঋণ দেওয়া বা একশো দিনের প্রকল্পে জবকার্ড দেওয়া কিছুই হয়নি।’’ একই বক্তব্য বিশ্বনাথবাবুরও। মন্টুবাবু বলেন, ‘‘৬০টি ভাটার সঙ্গে বিভিন্নভাবে প্রায় তিনশো মানুষের রোজগার হত। ভাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমাজের উপকার হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু মানুষগুলি যাতে ফের পুরনো পেশায় ফিরে না যান সেটাও সরকারকে দেখতে হবে।’’
গ্রামের রাস্তা মেরামত হয়নি দীর্ঘদিন। লাটিম দলুই নামে এক প্রাক্তন ভাটি ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘রাস্তা মেরামত হলে আমাদের বাড়ির ছেলেরা অটো চালিয়ে উপার্জন করত। কয়েকজন অটোও কিনেওছিল। কিন্তু বেহাল রাস্তার জন্য অটো বসিয়ে দিয়েছে।’’
ভাটি মালিকদের এই দাবিগুলি নিয়ে তাঁরা উলুবেড়িয়ার তৎকালীন মহকুমাশাসকের কাছে্ গিয়েছিলেন বলেও জানান কল্যাণীদেবী। তাঁর অভিযোগ, ‘‘প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই মেলেনি।’’ তবে বিষয়টি খোঁজ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মহকুমাশাসক তুষার সিংলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy