Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

বিসর্জনের তিক্ততা মুছেছে মিলন মেলা

একটাই ঘাট। গ্রাম আঠারো। কে আগে প্রতিমা বিসর্জন করবে তা নিয়ে মারামারি হয়েছিল পুজো কমিটিগুলির মধ্যে। পরিস্থিতি সামলাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী নামিয়েছিল প্রশাসন। পুরশুড়ায় সেই গণ্ডগোলের ইতিহাস পঞ্চাশ বছরেরও বেশি।

—নিজস্ব চিত্র।

—নিজস্ব চিত্র।

পীযূষ নন্দী
আরামবাগ শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০২:২৭
Share: Save:

একটাই ঘাট। গ্রাম আঠারো। কে আগে প্রতিমা বিসর্জন করবে তা নিয়ে মারামারি হয়েছিল পুজো কমিটিগুলির মধ্যে। পরিস্থিতি সামলাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী নামিয়েছিল প্রশাসন। পুরশুড়ায় সেই গণ্ডগোলের ইতিহাস পঞ্চাশ বছরেরও বেশি।

প্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে ১৮টি গ্রামের সেই মারামারির ইতিহাস বদলে গিয়ে এখন ৪ ঘণ্টার মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। দশমীর দিন দামোদর নদীর গায়ে পুরশুড়ার খুশিগঞ্জ ফেরিঘাট সংলগ্ন ওই ‘নিরঞ্জন মেলা’ এ বার ৫৯ বছরে পড়ল। এই দিনটিতে মেলায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ মিষ্টিমুখ এবং বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। যা আরামবাগ মহকুমায় সম্প্রীতির মেলা হিসেবেও খ্যাত। খুশিগঞ্জ ব্যাবসায়ী সমিতি পরিচালিত এই মেলা দেখে মহকুমা পুলিশ প্রশাসন নানা পুরস্কারও চালু করেছে। মঙ্গলবার সেই মেলা হয়ে গেল।

খুশিগঞ্জ ব্যাবসায়ী সমিতি ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ১৯২৭ সাল নাগাদ খুশিগঞ্জ ব্যাবসায়ী সমিতির দুর্গা পুজোর সূচনা করে। সেই সময় শুধুমাত্র খান তিনেক প্রতিমা খুশিগঞ্জ ফেরিঘাটে বিসর্জন হতো। ব্যবসায়ী সমিতির পুজোর রমরমা ও বিসর্জনের পরে মিষ্টিমুখের উৎসব এলাকায় সাড়া ফেলে। এর পরই যে সব গ্রাম নিজেদের গ্রামের পুকুরেই প্রতিমা বিসর্জন করতেন তাঁরাও ক্রমশ খুশিগঞ্জ ফেরিঘাটে বিসর্জনের আয়োজন করেন। এ ভাবেই বাকরপুর, সোঁয়ালুক, বৈকুন্ঠপুর, ভাঙ্গামোড়া, জোলকুল, ফুলবাগান, সাহাপুর এবং খুশিগঞ্জ সংলগ্ন বর্ধমানের জামালপুর থানার কোরা বারোয়ারি ও মনসা বারোয়ারি কমিটি মিলিয়ে মোট ১৮টি পুজো কমিটি এই একটি নদীঘাটে বিসর্জনের ভাগিদার হয়ে যায়। তখন থেকেই কে আগে এবং কতক্ষণ ধরে বিসর্জন উৎসব করবে তা নিয়ে প্রায়ই মারামারি, রক্তারক্তি হতো। ১৮টি পুজো কমিটির প্রতিমা বিসর্জন প্রক্রিয়া সামালতে হিমসিম খেতে হতো পুলিশকে।

অবশেষে ১৯৫৭ সাল নাগাদ খুশিগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতি এই পরিস্থিতি বদলাতে পুলিশকে রেখে খুশিগঞ্জ ফেরিঘাটে বিসর্জন করা সমস্ত পুজো কমিটিগুলিকে নিয়ে বৈঠকে বসে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কে কার পরে প্রতিমা বিসর্জন করবে তা প্রতি বছর বৈঠক করে কিংবা প্রয়োজনে লটারি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে মেলারও আয়োজন করা হয়।

কয়েক বছর এই মেলার সাফল্যর পর পুলিশ প্রশাসন পুরস্কার দেওয়ারও ব্যবস্থা করে। মেলার মাঠে চুন দিয়ে ১৮টি গোল দাগ করা হয়। বিকেল ৪টা থেকে যে যার নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিমা বসাবে ওই চুনের বৃত্তাকার অংশে। মেলায় দোকান বসে যায় দুপুর ২টো থেকেই। প্রায় হাজার তিরিশ মানুষের সমাগম হয় মেলায়। প্রচুর পুলিশও থাকে। সব কটি প্রতিমা বিসর্জনের পরে গ্রামের মহিলারা সিঁদুর খেলেন নদীঘাটে। হিন্দু-মুসলমান কোলাকুলি ও একে অপরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করে।

প্রতি বছরের মতো এ বারও দশমীর দিন খুশিগঞ্জ হাটতলা ও দামোদর নদী সংলগ্ন ৫ বিঘা জুড়ে ফাঁকা মাঠে এই মেলা বসেছিল। নিয়ম করে বিকেল ৪টা মেলা শুরু হয়। শেষ হয় রাত ৮ টায়। ওই সময়ের মধ্যেই খুশিগঞ্জ সংলগ্ন পুরশুড়ার বিভিন্ন গ্রামের ১৬টি এবং বর্ধমানের জামালপুর থানা এলাকার ২টি প্রতিমা নিয়ে মোট ১৮টি প্রতিমা খুশিগঞ্জের ফেরিঘাটে বিসর্জন করার বাঁধাধরা সময়। প্রতিমার সাজসজ্জা, সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলির মানুষদের শৃঙ্খলাবোধ, শব্দ দূষণ নিয়ে সচেতনতা, নির্মল বাংলা-সহ স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদি নানা সামাজিক কর্মকান্ডের ট্যাবলো-পোস্টার-ফেস্টুনের মাপকাঠি দেখেই তিনটি পুজো কমিটিকে পুরস্কৃত করা হয় মহকুমা পুলিশ প্রশাসন থেকে। এ ছাড়াও যে গ্রামের পুজো কমিটি তাদের প্রতিমা নিয়ে প্রথম মেলায় হাজির হবে তাদের বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। মেলার দিন তিনেক পরেই কারা পুরস্কার পাচ্ছে তা ঘোষণা করে পুলিশ। সব ক্ষেত্রেই পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় নানা পুজো সামগ্রী।

মেলা কমিটি তথা খুশিগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক গোপালচন্দ্র দে বলেন, ‘‘১৮টি প্রতিমা একসঙ্গে দেখার আকর্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে এই ঘাট হয়ে উঠেছে মিলনস্থল।’’

অন্য বিষয়গুলি:

fair
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy