পাশাপাশি: রামনবমীর মিছিলে যোগদানকারীদের জল খাওয়াচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা। শনিবার, হাওড়ার পিলখানায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
চৈত্র শেষের দুপুরে রাস্তায় বেরিয়েছে রামনবমীর মিছিল। ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি উঠছে মুহুর্মুহু। খর রোদে ঝিকিয়ে উঠছে হাতে হাতে ধরা তলোয়ার। বাদ যায়নি শিশুরাও। তাদের হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছে অস্ত্র। চার দিকে কিঞ্চিত থমথমে পরিবেশ। এরই মধ্যে হঠাৎ মিছিলের সামনে এগিয়ে এলেন তাঁরা। হাতে ধরা ঠান্ডা জলের বোতল। মিছিলকারীদের ক্লান্তি দূর করতে তাঁদের হাতে সেই জল তুলে দিলেন মহম্মদ তারিক, মুজিবুর রহমানেরা। সশস্ত্র মিছিল দেখে এত ক্ষণ যাঁরা একটু হলেও চিন্তায় ছিলেন, তাঁদের মুখেও তখন চওড়া হাসি।
শনিবার এই দৃশ্য দেখা গেল হাওড়ার পিলখানায়। যেখানে রামনবমীর মিছিলে অংশ নেওয়া ভক্তদের ক্লান্তি কাটাতে এগিয়ে এলেন এলাকার মুসলিম বাসিন্দারা। রীতিমতো শামিয়ানা টাঙিয়ে শিবির তৈরি করেছিলেন তাঁরা। আর সেখান থেকেই তাঁরা ঠান্ডা জল তুলে দিলেন মিছিলে আসা আট থেকে আশির হাতে। শুধু তা-ই নয়, ভিড় হটিয়ে তাঁরাই রাস্তা তৈরি করে দিলেন মিছিল এগোনোর জন্য।
প্রতি বছরের মতো এ বারও রামনবমী উপলক্ষে ডবসন লেন থেকে শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল হাওড়ার খটিক সমাজ। পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা মিলিয়ে শনিবার দুপুরে ওই শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন শ’পাঁচেক ভক্ত। সকলেরই গলায় ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা উত্তরীয়। নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই শোভাযাত্রায় বড়দের পাশাপাশি শিশুদের হাতেও ছিল খোলা তলোয়ার। মিছিলে অংশ না নিলেও ভক্তদের মাঝে এসে তলোয়ার নিয়ে ছবি তুলতে দেখা গিয়েছে এ বারের হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী শুভ্রা ঘোষকে। এ বিষয়ে শুভ্রাদেবী পরে বলেন, “রামনবমীর দিন অস্ত্র হল দুষ্টকে দমনের প্রতীক। তাই এ দিন পুজোমণ্ডপে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম।”
মিছিলের আয়োজক হাওড়া খটিক সমাজের সভাপতি বিবেক সোনকার জানান, পুলিশের অনুমতি নিয়েই মিছিল করা হয়েছে। গত ৬০ বছর ধরে রামনবমীর দিন এই শোভাযাত্রা বেরোচ্ছে। ওই মিছিলে সব রাজনৈতিক দলকেই তাঁরা আমন্ত্রণ জানান। বিবেক বলেন, ‘‘আমরা নবরাত্রি উপলক্ষে দুর্গাপুজো করি। মায়ের পুজোয় ২১ থেকে ৩১টি অস্ত্র লাগে। সেগুলি নিয়েই শোভাযাত্রা হয়। পুলিশের অনুমতিও নেওয়া হয়।’’ কিন্তু লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ না মেনে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করা যায় কি? সে প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলেনি।
এ বিষয়ে হাওড়ার মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক তথা জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মিছিলে অস্ত্র নিয়ে গেলে আমার কিছু বলার নেই। পুলিশ যা বলার বলবে।’’ হাওড়ার পুলিশ কমিশনার বিশাল গর্গকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি। জবাব দেননি মেসেজের। তবে এ দিনের ওই মিছিলকে কেন্দ্র করে এলাকার সংখ্যালঘু মানুষ যে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা একটা উদাহরণ হয়ে থেকে গেল বলেই মনে করছেন শহরবাসী।
এ দিন দুপুর ২টো নাগাদ মিছিল শুরু হয় ডবসন লেন থেকে। তীব্র গরমে প্রায় পুড়তে পুড়তে মিছিলকারীরা এসি মার্কেট ও ঘাসবাগান হয়ে জিটি রোড দিয়ে পিলখানার কাছে পৌঁছন। আর ঠিক তখনই তাঁদের সামনে ঠান্ডা জলের বোতল তুলে ধরেন মহম্মদ তারিক, মুজিবুর রহমনেরা। এর পরে রাস্তা থেকে ভিড় সরিয়ে তাঁদের যাওয়ার পথও করে দেন এলাকার মুসলিম বাসিন্দারা।
জল খাইয়ে তৃপ্তি এনে দিয়ে নিজেরাও তৃপ্ত তাঁরা। ‘পিলখানা ফ্রেন্ডস সোসাইটি’ নামে স্থানীয় একটি ক্লাবের সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘‘এই গরমে মানুষগুলো এতটা পথ হাঁটছেন! তাই মানবিকতার খাতিয়ে এইটুকু তো করতেই হয়। আমরা শ’দেড়েক সদস্য মিলে প্রায় ৫০০ জলের বোতল কিনে জিটি রোডের উপরে এই ব্যবস্থা করেছিলাম। এর সঙ্গে ধর্ম, সম্প্রদায় বা রাজনীতির কোনও যোগ নেই।’’
রামনবমীর শোভাযাত্রায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই ভূমিকায় খটিক সমাজের সভাপতি নিজেও আপ্লুত। বিবেক সোনকার বলেন, ‘‘হাওড়া কিন্তু দেখিয়ে দিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কাকে বলে! এই সম্প্রীতি বিশ্বের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy