আদালত থেকে বের করে আনা হচ্ছে তপনকে। নিজস্ব চিত্র
কারখানার জমির ভাড়া বাকি পড়ে গিয়েছিল। তার উপরে ছিল ধারে নেওয়া কয়েক লক্ষ টাকা। টাকা শোধের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন জমির মালিক। সেই কারণে তাকে খুন করে বাবা-মায়ের সাহায্যে দেহ বস্তায় ভরে পড়শির সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দিয়েছিল এক যুবক।
প্রায় এক যুগ আগে উত্তরপাড়ার মাখলার বাসিন্দা শৈলেন্দ্রকুমার শর্মা নামে ওই যুবককে খুনের ঘটনায় ডানকুনির গোবরার শিবতলা এলাকার বাসিন্দা তপন বাগকে শনিবার ফাঁসির সাজা শোনালেন শ্রীরামপুর আদালতের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক মহানন্দ দাস। তপনের বাবা নিরঞ্জন এবং মা সন্ধ্যার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। মামলার অপর তিন অভিযুক্ত অবশ্য বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এই ফাঁসির সাজা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোড়ন পড়েছে ওই আদালতের আইনজীবীদের একাংশের মধ্যে।
মামলার দু’জন সরকারি আইনজীবী ছিলেন। মোহনলাল নাড়ু এবং মুসা মল্লিক। মুসা বলেন, ‘‘ঘটনার নৃশংসতা দেখে বিচারক ঘটনাটিকে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলে মনে করেছেন। বিনা দোষে শৈলেন্দ্র খুন হওয়ায় তাঁর পরিবারের উপরেও চরম আঘাত নেমে আসে। আদালত এই বিষয়টিকেও মাথায় রেখেছে।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, বছর পঁয়তাল্লিশের শৈলেন্দ্র লোহার কারবারি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তপনের পরিচয় ছিল। শৈলেন্দ্রর বাড়িতে জমি ভাড়া নিয়ে তপন নাট-বোল্ট তৈরির কারখানা করেছিল। ব্যবসার জন্য সে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ধারও নিয়েছিল শৈলেন্দ্রের থেকে। কিন্তু ধার শোধ করছিল না। টাকা চেয়ে
শৈলেন্দ্র তাগাদা করছিলেন। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে টাকা দেওয়ার নাম করে বছর পঁয়তাল্লিশের শৈলেন্দ্রকে নিজের বাড়িতে ডাকে তপন। কাটারি দিয়ে কুপিয়ে তাঁকে খুন করে। রক্তাক্ত দেহ একটি প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে কাছেই একটি বাড়ির (ওই বাড়ির লোকেরা অন্যত্র থাকতেন) সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দেয়। গোটা পর্বে তাকে সাহায্য করেছিল বাবা-মা।
স্বামীর খোঁজ না পেয়ে শৈলেন্দ্রর স্ত্রী ইন্দু শর্মা ওই বছরের ১২ এপ্রিল উত্তরপাড়া থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। তার দু’দিন পরে তপনের প্রতিবেশীর বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে দুর্গন্ধ বেরনোয় স্থানীয় মানুষ পুলিশে খবর দেন। পুলিশ সেখান থেকে শৈলেন্দ্রর ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার করে। শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে দেহের ময়নাতদন্ত হয়। সে দিনই উত্তরপাড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ইন্দু।
ওই অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করে উত্তরপাড়া থানার পুলিশ। পরে মামলার তদন্তভার নেয় সিআইডি। অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়। তপনের কথামতো তার বাড়ির পাশের গোয়ালঘর থেকে খুনে ব্যবহৃত রক্তমাখা কাটারিটি উদ্ধার হয়। তার জিম্মা থেকে শৈলেন্দ্রর হাতের আংটি, রক্তমাখা পোশাকও মেলে। ধনেখালির একটি গ্যারাজে নিহতের মোটরবাইক মেলে। তপনের বাড়িতে বাইকটির কাগজপত্র পাওয়া যায়। মামলার তদন্তকারী অফিসার বাসুদেব ঘোষ আদালতে চার্জশিট জমা দেন। খুন, তথ্যপ্রমাণ লোপ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অপহরণ এবং চুরির ধারায় আদালতে চার্জগঠন হয়।
সিআইডি সূত্রের খবর, পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে রীতিমতো ছক সাজিয়েছিল তপনেরা। তারা ভেবেছিল, পড়শির বাড়িতে কেউ না-থাকায় সেপটিক ট্যাঙ্কে দেহ ফেলে দিলে কেউ টের পাবে না। খুনে ব্যবহৃত কাটারিটিও লুকিয়ে ফেলেছিল। লোভের বশবর্তী হয়ে শৈলেন্দ্রর দেহ থেকে আংটি খুলে নিয়েছিল তারা। পুলিশকে বোকা বানাতেই শৈলেন্দ্রর মোটরবাইক ধনেখালিতে রেখে আসা হয়। নানা বুদ্ধি খাটিয়েও অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি। তপনদের প্রতিবেশী সোমনাথ ও স্বপন হাতি নামে দুই ভাই এবং তাঁদের বাবা গোপাল হাতিকেও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারায় মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা গ্রেফতার হন। তিন জনেই পরে জামিন পান। তপনের বাবা-মাও জামিন পায়। তপন অবশ্য জামিন পায়নি। সে জেল থেকে পালিয়েও ধরা পড়ে যায়।
সরকারি আইজীবী জানান, আদালতে মোট ৫৬ জন সাক্ষ্য দেন। শুক্রবার বিচারক তপন, নিরঞ্জন ও সন্ধ্যাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। প্রমাণাভাবে সোমনাথ, স্বপন এবং তাঁদের বাবা গোপাল হাতিকে বিচারক বেকসুর খালাস ঘোষণা করেন। শনিবার বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে তপন এবং তার বাবা-মা দাবি করে, তারা নির্দোষ।
মামলা চলাকালীন বাসুদেববাবু অবসর নেন। শুনানিতে সিআইডি-র তরফে দায়িত্ব সামলেছেন সুদীপ বিশ্বাস। তিনি এ দিন আদালতে এসেছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সাজাপ্রাপ্তেরা মুখ খোলেনি। তাদের আইনজীবীও কিছু বলেননি। তবে, মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিয়ে আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, এই খুনের ঘটনাটি বিরলের মধ্যে বিরলতম বলে তাঁরা মনে করেন না।
সোমনাথদের আইনজীবী ছিলেন সিদ্ধেশ্বর বেজ। বর্ষীয়ান এই আইনজীবী বলেন, ‘‘ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। আসামি নিজেও দেহ উদ্ধার করে দেয়নি। শুধু তথ্যপ্রমাণের উপরে ভিত্তি করে আদালত রায় দিয়েছে। আমার মনে হয়, ঘটনাটি বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়।’’ অভিজ্ঞ আর এক আইনজীবীর কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন অনুযায়ী, আসামি যদি সমাজের কাছে অত্যন্ত ঘৃণ্য হয়, তার শোধরানোর সম্ভাবনা না থাকে, তার বেঁচে
থাকা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে এবং সেই ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ থাকে, সে ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এই ঘটনাও তেমন কিনা, খুঁটিয়ে দেখতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy