নিষিদ্ধ: লুকিয়ে এই অ্যাসিডই বিক্রি হচ্ছে পান্ডুয়ার দোকানে। ছবি: সুশান্ত সরকার
হয়তো ততটা সহজ হত না। কিন্তু মুম্বই ছেড়ে ডোমজুড়-উলুবেড়িয়ায় এসেও ‘স্টিং’ অপারেশন চালাতে পারতেন দীপিকা পাড়ুকোন। কৌশলে কী ভাবে এ রাজ্যের এক জেলার গ্রামীণ এলাকায় প্রায় অবাধেই অ্যাসিড মেলে, তার ফুটেজ নিয়ে যেতে পারতেন।
গত তিন বছরের মধ্যে গ্রামীণ হাওড়ায় সাকুল্যে একদিন বেআইনি অ্যাসিড বিক্রি ধরতে অভিযান চলে। তারপরে দোকানদারদের অ্যাসিড বিক্রির নিয়ম-কানুন জানিয়েই দায় সারে প্রশাসন। নজরদারির অভাবে এখন রমরমিয়ে চলছে বেআইনি ভাবে অ্যাসিড বিক্রি ও মজুত করা। পাশের জেলা হুগলির গ্রামীণ এলাকাতেও নজরদারির ফাঁকে অ্যাসিড কেনা সহজলভ্য বলে অভিযোগ।
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ছপক’ ছবিতে এক অ্যাসিড আক্রান্তের ভূমিকায় অভিনয় করেই দীপিকা থামেননি। তাঁর ‘টিম’ নিয়ে মুম্বইয়ের বিভিন্ন দোকানে ‘স্টিং’ অপারেশনও চালিয়েছেন অভিনেত্রী। নানা পেশার মানুষের ছদ্মবেশে ওই টিমের লোকেরা কত সহজে এবং অবাধে দোকান থেকে মারাত্মক অ্যাসিড কিনছেন, তা ধরা পড়েছে লুকোনো ক্যামেরায়। এক দিনে মিলেছে ২৪ বোতল অ্যাসিড। সেই ভিডিয়ো প্রকাশ্যেও এসেছে। সেখানে দীপিকা বলছেন, ‘‘এটা যদি বিক্রি না হত, তা হলে ছোড়াও হত না।’’
এখন গ্রামীণ হাওড়ার বাগনান, আমতা বা উলুবেড়িয়ার বেশিরভাগ হার্ডওয়্যারের দোকানে গেলেই শোনা যাবে, অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ। কেন? ব্যবসায়ীদের দাবি, ‘‘বিস্তর ঝামেলা। তাই বিক্রি বন্ধ।’’ তা হলে গয়না কারখানাগুলি চলছে কী করে? ওই কারখানাগুলিই অ্যাসিডের (সালফিউরিক এবং নাইট্রিক) বড় ক্রেতা।
ওই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই সামনে আসে অন্য ছবি। গয়না কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নিয়মের আড়ালেই বেনিয়ম চলে। তাঁরা জানান, অচেনা খরিদ্দারদের সাধারণত হার্ডওয়্যার দোকানের মালিক অ্যাসিড বিক্রি করেন না। তাই তাঁদের সঙ্গে নির্দিষ্ট কারিগরদের আলাপ করিয়ে দেন গয়না কারখানার মালিকেরা। সেই চেনাজানার সুবাদে ওই কারিগররাই প্রয়োজনীয় অ্যাসিড নিয়ে আসেন। নাম-ঠিকানা লেখানোর বালাই নেই। এ ছাড়াও জেলা জুড়ে আছে বেআইনি অ্যাসিড কারবারের বড় চক্র। মূলত যাঁরা গয়না তৈরির যন্ত্রপাতির জোগান দেন, তাঁরাই এর সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা বেআইনি ভাবে অ্যাসিড সংগ্রহ করে এনে গয়না কারখানার মালিকদের খবর দেন। তাঁরা গোপন জায়গা থেকে তা কিনে নেন। জেলার অন্যত্রও এ ভাবে গয়না কারখানার মালিকেরা অ্যাসিড সংগ্রহ করেন। ফলে, ওই পথে দুষ্কৃতীদের হাতেও অ্যাসিড পৌঁছনোর আশঙ্কা থেকে যায়।
ডোমজুড়ের এক গয়না কারখানার মালিক মানছেন, ‘‘আইন মেনে অ্যাসিড কেনায় নানা বাধা। তাতে ব্যবসা চালানো মুশকিল। তাই বাঁকা পথ নিতে হয়।’’ হুগলির পান্ডুয়া, মগরা এবং আরামবাগের গয়না ব্যবসায়ীরা জানান, হকারদের ফোন করলে তাঁরাই দোকানে এসে অ্যাসিড দিয়ে যান। হকারদের অ্যাসিড বিক্রির লাইসেন্স আছে কিনা, তা তাঁরা জানেন না।
অ্যাসিড হামলা বেড়ে যাওয়ায় বছর তিনেক আগে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় হার্ডওয়্যার এবং গয়নার কারখানাগুলিতে হানা দেওয়া শুরু করে পুলিশ প্রশাসন। বাগনান এবং উলুবেড়িয়ার ১০টি জায়গায় হানা দিয়ে সেই সময় বেআইনি ভাবে মজুত করা অ্যাসিড বাজেয়াপ্ত করা হয়। দেখা যায়, ওই সব দোকানদারদের লাইসেন্স থাকলেও তা দীর্ঘদিন নবীকরণ হয়নি। কারা কী উদ্দেশ্যে অ্যাসিড কিনেছেন তার কোনও নথি যেমন হার্ডওয়্যারের দোকানে ছিল না, তেমনই গয়না কারখানার মালিকেরাও অ্যাসিড মজুতের স্বপক্ষে কোনও কাগজ দেখাতে পারেননি।
তারপরেই মহকুমা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইন মেনে চলার নিদান দেওয়া হয়। হার্ডওয়্যার দোকানের মালিকদের বলা হয়, প্রতি মাসে কত অ্যাসিড মজুত আছে, তার হিসাব রাখতে হবে। অ্যাসিড ক্রেতাদের নাম-ঠিকানা এবং তা কেনার কারণ লিখে রাখতে হবে। ওই বিবরণ সংবলিত খাতা প্রতি মাসে জেলাশাসকের অফিসে দেখিয়ে লাইসেন্স নবীকরণ করাতে হবে। গয়নার কারবারিদেরও বলা হয় প্রতি মাসে তাঁরা কত অ্যসিড কিনলেন, কত খরচ হল তার হিসাব যেন প্রতি মাসে জেলাশাসকের অফিসে দাখিল করা হয়। এই সব নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট বিডিও-রা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে মাঝেমধ্যে যাচাই করবেন। যাঁরা এই নিয়ম মানবেন না, তাঁদের লাইসেন্স বাতিল করার সুপারিশ করবেন।
কিন্তু প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে, ওই নির্দেশ জারির পর থেকে আর উলুবেড়িয়া মহকুমা এবং হাওড়া সদর এলাকায় কোনও অভিযানের খবর নেই। কাজেই কোন ফাঁক দিয়ে কোন দুষ্কৃতীর হাতে অ্যাসিড পৌঁছচ্ছে, তা জানার উপায় নেই। গত তিন বছরে গ্রামীণ হাওড়ায় দু’টি অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। অন্য জেলাতেও এমন হামলার উদাহরণ রয়েছে।
ফলে, এই আবহে দীপিকার কথাটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এটা যদি বিক্রি না হত, তা হলে ছোড়াও হত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy