মিলেমিশে: বিনোদবিহারী পাত্রের কবরের সামনে পরিজনরা। নিজস্ব চিত্র
তিনি চেয়েছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ যেন বৈদ্যুতিক চুল্লিতে সৎকার করা হয়। তা সম্ভব হয়নি। পরিবারের লোকজন মৃতদেহ কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কবর খুঁড়বে কে? এগিয়ে এলেন লুৎফর শেখ, জালাল মল্লিকরা!
গত মঙ্গলবার বাগনানের কল্যাণপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা, বৃদ্ধ সিপিএম নেতা বিনোদবিহারী পাত্রের (৮৫) শেষকৃত্যের রেশ এখনও রয়ে গিয়েছে গ্রামবাসীদের মনে। শুধু কবর খোঁড়াই নয়, বিনোদবাবুর পরিবারের লোকজন এবং হিন্দু গ্রামবাসীদের সঙ্গে ওই কবরে মাটিও দেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই মানুষেরা। যা দেখে বৃদ্ধের মেয়ে কাকলি সিংহ বলেন, ‘‘বাবা সারাজীবন মানুষের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। জাতি-ধর্ম দেখেননি। সেই সাধারণ মানুষরাই একযোগে জাতি-ধর্মের উর্ধ্বে উঠে তাঁকে কবরস্থ করেছেন। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে!’’ আর জালালের কথায়, ‘‘আমার বাবা যখন মারা গিয়েছিলেন, তাঁকে ‘গোর’ দেওয়ার সময়ে বিনোদবাবু হাজির ছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁকেও যেন এ ভাবে কবরস্থ করা হয়। ওই পরিবারটি সমস্যায় পড়েছিল। সাহায্য করব না?’’
বিনোদবাবু আজীবন সিপিএম সদস্য ছিলেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন কল্যাণপুর পঞ্চায়েতের প্রধান। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাগনান-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন। কল্যাণপুর হাইস্কুলের প্রাক্তন ওই বিজ্ঞান-শিক্ষক সিপিএম করলেও দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের প্রিয় ছিলেন। ২০০৩ সালের পর থেকে আর কোনও নির্বাচনে দাঁড়াননি। তবে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। শেষ কয়েক বছর অবশ্য অসুস্থতার কারণে বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোতেন না। বাড়ি থেকে কিছু দূরে প্রায় ১০ কাঠা জমিতে ফলের বাগান করেছিলেন। পরিচর্যা করেই সময় কাটাতেন।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ হয়ে পড়েন বিনোদবাবু। ভর্তি করানো হয়েছিল হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই ৩ মার্চ সকালে তিনি মারা যান। সেই সময়ে হাসপাতালে ছিলেন বৃদ্ধের ছোট ছেলে শুভাশিস এবং মেয়ে কাকলি। তাঁরা চিন্তায় পড়েন। কারণ, তাঁদের বাবা গ্রামে কাঠের চিতায় দাহ করার বিরোধী ছিলেন। বৈদ্যুতিক চুল্লির জন্য দেহ নিয়ে যেত হত শিবপুরে। যা সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া, দেহ নিয়ে গ্রামে ফিরতে হতোই।
এ সব কথাই শুভাশিস তাঁর দাদা দেবাশিসের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেন। তারপরেই তাঁরা ঠিক করেন, বাবার দেহ গ্রামে, বাবার গড়া বাগানেই কবরস্থ করবেন। তাঁদের মা স্বপ্নাদেবীও মত দেন। যাবতীয় ব্যবস্থার জন্য দেবাশিস গ্রামে তাঁদের আত্মীয়দের বলেন। কিন্তু কবর কী ভাবে খুঁড়তে হয় কী করে জানবে ওই হিন্দু পরিবার? তাঁর শরণাপন্ন হন লুৎফর, জালালদের। দেবাশিসের আত্মীয় বীরেন পাত্র বলেন, ‘‘সব শুনে লুৎফররা দল বেঁধে এসে আমাদের থেকে কোদাল নিয়ে নিজেরাই সব ব্যবস্থা করে দেন।’’ লুৎফরই কবর খোঁড়ায় নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘‘কবর খোঁড়ার পদ্ধতি আছে। ওঁরা সেটা জানবেন কী করে?’’
সে দিন বিকেল ৪টে নাগাদ যখন দেহ আসে, ততক্ষণে কবর খোঁড়ার কাজ শেষ। দেহ যখন কবরে নামানো হয়, তখনও হাত লাগান লুৎফর, জালালরা। তার পরে কবরের চারদিকে তাঁরাই বেড়া দিয়ে দেন। যেমনটি করা হয় কবর দেওয়ার পরে। দুই সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্যের ফুলে ঢেকে যায় বিনোদবাবুর কবর।
বিনোদবাবু নিজে নাস্তিক ছিলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের স্বাধীন ধর্মাচরণে বাধা দিতেন না। বাড়িতে পুজো ও নানা আচার পালন করেন তাঁর স্ত্রী স্বপ্নাদেবী। মুসলিমদের সহযোগিতায় তাঁর স্বামীর দেহ কবরস্থ করা নিয়ে স্বপ্নাদেবী বলেন, ‘‘যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। হিন্দু বা মুসলিম বড় কথা নয়, সবাই মানুষ। ওঁরা আমার স্বামীকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। ওঁরাই হাত লাগিয়েছেন।’’
শুধু ধর্ম নয়, এই মৃত্যু ভেঙেছে রাজনীতির বেড়াও। বিনোদবাবুর দেহ কবরস্থ করার সময়ে হাজির ছিলেন তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য শেখ আসফারুল। তিনি বলেন, ‘‘বিনোদবাবু ভিন্ন রাজনীতি করতেন। কিন্তু সব সম্প্রদায় ও দলের মানুষের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দেশের বর্তমান অবস্থার কথা ভাবলে আমাদের এই প্রচেষ্টা সম্প্রীতির নজির হয়ে থাকবে।’’ একই কথা শোনা গেল অন্যদের মুখেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy