শীলদের কাছারিবাড়ির এখনকার চেহারা।
একটা পুরনো আর একটা নতুন। শহর বাগনান নিজেকে দুই সত্তায় ভেঙে নিয়েছে।
পুরনো সত্তা জুড়ে রয়েছে কাছারিপাড়া। পুরাতন বাজার পর্যন্ত যার বিস্তার। আর তার পর থেকেই ওটি রোড, স্টেশন রোড হয়ে খালোড় পর্যন্ত নতুন সত্তার তালুকদারি।
একদিকে যেমন অনুন্নয়নের অন্ধকারে ডুবে পুরনো সত্তা, তেমন নতুন সত্তারও সমস্যার অন্ত নেই। নগরায়নের ছোঁয়া পেয়ে এখানেও মাথা তুলছে একের পর এক বহুতল, বাড়ছে প্রমোটারদের খবরদারি। পাশাপাশি গড়ে উঠছে ছাপোষা মধ্যবিত্তের একফালি বসতভিটে। কিন্তু এর বেশিরভাগই অপরিকল্পিতভাবে হওয়ার ফলে হাওড়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মফস্সল শহরের আজ বড় মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার নিকাশি ব্যবস্থা। বর্ষার সময় শহরের বিভিন্ন এলাকা ডুবে যায়। শহরের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যানবাহন ও সেই সঙ্গে যানজটও। বাগনানবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি মেনে শহরের উত্তর ও দক্ষিণ ভাগকে উড়ালপুল দিয়ে জুড়েছে রেল ও রাজ্য সরকার। তাতে বাগনান লেভেল ক্রসিংয়ে যানজটের সমস্যার অনেকটা সমাধান হলেও মূল শহরের যানজটের সমস্যা সে ভাবে মেটেনি।
প্রায় দেড়শো বছর আগে মুম্বই রোডের উত্তরদিকে বাগনান গ্রামে কলকাতাক কয়েকজন জমিদার তৈরি করেছিলেন দু’টি কাছারিবাড়ি। তাঁরা এখানে পা রাখতেন কালেভদ্রে। কিন্তু কাছারিবাড়ি দু’টিকে কেন্দ্র করে এলাকা ছিল জমজমাট। জমিদারদের জমিদারি চলত এখান থেকেই। সেই কাছারিবাড়ির সূত্রেই আজকের বাগনানের কাছারিপাড়া। জমিদাররা এখানে তৈরি করেছিলেন বাঘেশ্বরী মন্দির, ছিল বৃন্দাবন মন্দির। অদূরেই বাগনান থানা। ঘোড়ায় চেপে সে সময়ের পুলিশকর্তাদের দাপটের গল্প এখনও স্থানীয় প্রবীণদের মুখে মুখে ফেরে। তবে পুরনো সে সবের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বৃন্দাবন মন্দির রূপ বদলে এখন পোড়ো বাড়ি। বাঘেশ্বরী মন্দিরের অবশ্য সংস্কার করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই। বৃন্দাবন মন্দির থেকে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে তাঁরা তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করেছেন এই মন্দিরে।
এক সময়ের বিখ্যাত পুরাতন বাজারের হতদরিদ্র দশা।
কেন সংস্কার হল না বৃন্দাবন মন্দিরের?
কারণ হিসাবে টাকার অভাবকেই দায়ী করলেন বাঘেশ্বরী মন্দির কমিটির পক্ষে চন্দ্রনাথ বসু। পুরনো দু’টি কাছারিবাড়িও সংস্কারের অভাব বেহাল। জমিদারী আমলে এই কাছারিবাড়িতে যাঁরা কর্মচারী ছিলেন তাঁদেরই কিছু উত্তরপুরুষ এখন বসবাস করেন এখানে। যে টুকু মেরামতি হয়েছে তা তাঁদের নিজেদের প্রয়োজনেই। মানুষজনের ভিড়ে কীরকম জমজমাট ছিল এক সময় এই এলাকা, সুবিশাল ভবন দু’টি যেন তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। একটি কাছারিবাড়িতে বসবাস করেন সোমনাথ বসু। বাবা ছিলেন কাছারির তহশীলদার। সোমনাথবাবুর কথায়, ‘‘পুরোদস্তুর অফিসপাড়া ছিল এই এলাকা। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসতেন। গরুর গাড়িতে করে খাজনার ধান আসত। গাড়োয়ানদের থাকার আলাদা ঘর ছিল। সবই অবশ্য বাবা, দাদুদের মুখে শোনা।”
সংস্কারের অভাবে পোড়োবাড়িতে পরিণত হয়েছে বৃন্দাবন মন্দির।
পাশেই ছিল থানা, যা আজও থানার ডাঙা নামে পরিচিত। ৯৩ বছরের হাতেম আলি বললেন, ‘‘আমরা দেখিনি, তবে ছেলেবেলায় শুনেছি শেরিফ দারোগার নাম। ঘোড়ায় চড়ে মাথায় টুপি পরে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি। মানুষ তাঁর ভয়ে কাঁপত।’’ থানার ডাঙা নামটি থাকলেও আজ আর থানার কোনও চিহ্নই নেই। স্বাধীন ভারতে জমিদারি প্রথা লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রমরমার শেষ হয়েছিল কাছারিপাড়ার। তারও আগে থানা উঠে গিয়েছিল ওটি রোডের ধারে। জমিদারীর অনুদান কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন ও বাঘেশ্বরী মন্দিরের দেওয়ালের পলেস্তারাও খসে পড়তে শুরু করেছিল। পুরনো বাগনান তার প্রাচীনতার খোলস ছেড়ে ক্রমশ এগিয়ে গেল নতুন অভিমুখে।
পুরনো বাগনান যে শুধু দু’টি কাছারিবাড়ি, দু’টি মন্দির, একটি থানা নিয়েই গড়ে উঠেছিল তা নয়। ছোটখাটো একটি গঞ্জও ছিল। যা আবর্তিত ছিল একটি বাজারকে কেন্দ্র করে, পুরাতন বাজার নামে আজও যার পরিচিতি। বাজারে ছোট ছোট খুপরি পাকা ঘরে চলত সোনার গয়না মেরামতি ও বন্ধকীর কারবার। টিনের চালাঘরের নীচে বসত কাঁচা আনাজ ও মাছের বাজার। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত বাজার গমগম করত ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে। এখন সে সব দিন নেই। বাগনান ১ পঞ্চায়েত সমিতির সৌজন্যে এখন সেখানে পাকা দালান। কিন্তু খদ্দের কমেছে। শোচনীয় অবস্থা কাঁচা সব্জী ব্যবসায়ীদেরও। “এখন তো বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে তিনচাকার চলমান বাজার। আমাদের কাছে এসে আর কী হবে?’’ গলায় হতাশার সুর বাজারে ৪২ বছর ধরে ব্যবসা করা সব্জী ব্যবসায়ী রমেশ মাইতি।
সংস্কারের জেরে এখনও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বাঘেশ্বরী মন্দির।
গাছের গোড়া কেটে দিলে যেমন তার ডালপালা শুকিয়ে যায়, তেমনই পুরাতন বাজারের কাঁচা আনাজ ও মাছের বাজারকে কেন্দ্র করে যে সব সোনার দোকান, রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকান গড়ে উঠেছিল, পুরাতন বাজারের রমরমা অস্তমিত হওয়ার পরে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে সে সবেরও। পুরাতন বাজারে ঘুরলে এখনও কানে আসবে সেই সব ব্যবসায়ীদের বিলাপ। একইরকম আক্ষেপ কাছারিপাড়ার বাসিন্দাদের মুখেও। এলাকার বুক চিরে চলে যাওয়া ইটের রাস্তা আজও পাকা না হওয়ার দুঃখ তাঁদের থেকে গিয়েছে। নিকাশি ব্যবস্থার অভাবে ইটের রাস্তার দুই ধারের নালায় থিকথিক করছে নোংরা জল।
আধুনিক বাগনানের রূপকারদের কাছে তাই প্রশ্ন বাসিন্দাদের, কাছারিপাড়া থেকে যে আধুনিক বাগনানের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানে আজও কেন তাঁদের কপালে জুটল না পাকা রাস্তা? কেন নেই ভাল নিকাশি ব্যবস্থা?
বলা বাহুল্য, মেলেনি উত্তর।
ছবি তুলেছেন সুব্রত জানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy