অটো, ট্রেকারের কারণে যানজট, পথচারীদের সামলাতে ব্যস্ত ‘জয়ন্ত পুলিশ’।
সমস্যা পাহাড় প্রমাণ। আর তার সামনে একা একটা মানুষ। অস্ত্র বলতে ছোট্ট একটা বাঁশি। তা নিয়েই নিত্যদিন সমস্যার সমাধানে একাই কুম্ভ জয়ন্ত। ভাল নাম জয়ন্ত দত্ত। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা। ফের বিকেল চারটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। দু’দফায় খাকি উর্দি পরে মাথায় টুপি আর ঠোঁটে বাঁশি নিয়ে বাগনান বাসস্ট্যান্ডে সকাল বিকেল দাঁড়িয়ে থাকা জয়ন্তকে দেখেননি এমন মানুষ পাওয়া ভার। বাগনান বাসস্ট্যান্ডের মানুষজন যাঁকে চেনেন ‘জয়ন্ত পুলিশ’ নামে।
কখনও বাঁশি ফুঁকে, কখনও আবার দাবড়ে-দুবড়ে অটো, ট্রেকার চালকদের সবক শেখান তিনি। কখনও কাজ হয়। কখনও হয় না। বাসস্ট্যান্ডে ঢোকা ও বেরোনোর সময়ে অটোরিকশা, ট্রেকার, ছোট গাড়ি আর বাসের দীর্ঘ লাইন পড়ে। অসহায় জয়ন্ত পুলিশের কপাল থেকে তখন ঘাম ঝরে। স্থানীয় বাসিন্দারাও জয়ন্ত পুলিশের অসহায়তার কথা স্বীকার করে আফশোস করেন। সত্যিই তো বাগনান বাস্টড্যান্ডের এই সমস্যা কী একজন মাত্র ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব?
বাগনান কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড। নামে ওজন থাকলেও অটোরিকশা, ট্রেকার এবং ছোট গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না-পেরে একের পর এক বিদায় নিয়েছে অধিকাংশ রুটের বাস। আর শেই শূন্যস্থান পূরণ করে নিয়েছে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলা অটো-রিকশা, ট্রেকার এবং ছোট গাড়ি। দখল হয়ে গিয়েছে বাসের ছেড়ে যাওয়া চ্যানেলগুলি। কিন্তু তাতেও ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী’র অবস্থা। ফলে চ্যানেল ছাড়িয়ে এই সব যান দখল করে নিয়েছে রাস্তাও। বাগনান বাসস্ট্যান্ডকে ঘিরে যানজটের নেপথ্যে রয়েছে যার বড় ভূমিকা।
হাওড়া জেলার অন্যতম প্রধান শহর বাগনানের প্রসিদ্ধি তার যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য। হাওড়া ছাড়াও পাশ্ববর্তী দুই মেদিনীপুর (পূর্ব ও পশ্চিম) এবং হুগলি জেলার বহু মানুষ বাগনান শহরে এসে কলকাতা এবং শহরতলিতে যাতায়াতের ট্রেন ধরেন। বাগনান শহরের বুক চিরে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-খড়্গপুর শাখার রেলপথ চলে গিয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম যাত্রীদের ভিড়ে গমগম করে। এই সব মানুষদের অধিকাংশ ট্রেন থেকে নেমে বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস, অটোরিকশা, ছোট গাড়ি, ট্রেকার ধরে বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের গন্তব্যে যান। একই ভাবে তাঁরা বাগনান শহরে এসে বিভিন্ন স্টেশনের ট্রেন ধরেন।
এক সময়ে বাসস্ট্যান্ডটি ছিল স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে। কিন্তু জায়গার অভাবে আট-এর দশকের প্রথম দিকে বর্তমান জায়গায় তা সরে আসে। তখন থেকে এটি কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড নামে পরিচিত। বাসস্ট্যান্ডটি বর্তমানে পরিচালনা করে বাগনান-১ পঞ্চায়েত সমিতি। বাগনান বাসস্ট্যান্ড থেকে একসময়ে মানকুর, বাকসি, বাইনান, শ্যামপুরের বিভিন্ন রুটের বাস ছাড়ত। কিন্তু ধীরে ধীরে অধিকাংশ রুটের বাস বন্ধ হয়ে যায়। ভিড় বেড়ে যায় ছোট গাড়ি, ট্রেকার এবং অটোরিকশার।
বর্তমানে যে গুটিকয় বাস চলে তার মধ্যে রয়েছে বাগনান-আমতা, বাগনান-জয়পুর, বাগনান-শ্যামপুর, বাগনান-কমলপুর, ধর্মতলা-শ্যামপুর প্রভৃতি। এ ছাড়া ধর্মতলা-বাগনান রুটে সিটিসি-র বাসও চলাচল করে।
ব্যস্ত সময়ে বাগনান বাসস্ট্যান্ডের অবস্থা।
ট্রেকার, অটো, ছোট গাড়ির দাপটে বাসস্ট্যান্ডে হাঁটাচলা করাই দায়, এমন অভিযোগ নিত্যযাত্রীদের দীর্ঘদিন ধরেই। শুধু তাই নয়, বাসস্ট্যান্ডে ঢোকা ও বেরোনোর সময়েও যাটজটের কবলে পড়তে হয়। তা ছাড়া অনেক সময় বাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অটো, ট্রেকার দাঁড়িয়ে যাওয়ায় বাস স্ট্যান্ড থেকে ছাড়তে ও স্ট্যান্ডে ঢোকার ক্ষেত্রেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়। সময় নষ্ট হয় যাত্রীদের। সব চেয়ে অসুবিধায় পড়েন সিটিসি বাসের যাত্রীরা। বাগনান থেকে সরাসরি এই বাসে ট্রেনের তুলনায় অনেক কম সময়ে কলকাতায় যাতায়াত করা যায়। ফলে এই বাস ধরার জন্য যাত্রীদের লম্বা লাইন পড়ে। কিন্তু বাসের সামনে অটো, ট্রেকারের দাপটে স্ট্যান্ডে ঢোকা বা বেরোনোর সময়ে বাসগুলি সমস্যায় পড়ে। সিটিসি-র বাগনান ডিপো সূত্রে জানানো হয়েছে, তাঁরা বিষয়টি পঞ্চায়েত সমিতির নজরে এনেছেন, যাতে সিটিসি বাসের চ্যানেলে কোনও অটো, ট্রেকার না ঢোকে। কারণ এর ফলে বাস ছাড়ার ক্ষেত্রে দেরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই দেরির কারণে ট্রিপ বাতিলও করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।
অটো, ট্রেকার থেকে ছোট গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে আইএনটিটিইউসি। সংগঠনের বাগনান এলাকার সভাপতি কাজি শাহনওয়াজের অবশ্য দাবি, তাঁরা ছোট গাড়ি এবং অটো চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, “বাগনানে গত দশ বছর ধরে অটো এবং ছোট গাড়ির ভিড় বাড়ছে। গত দু’বছর ধরে আমরা বাসস্ট্যান্ডে বেআইনি অটো, ছোট গাড়ি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছি। তা সত্ত্বেও এখনও অনেক অটো, ট্রেকার চলাচল করে। আমরা তাদের বলেছি বাসের চ্যানেল আটকে না রাখতে।” তবে একইসঙ্গে তিনি জানান, বাসস্ট্যান্ড সম্প্রসারণ করা না-হলে এই সমস্যা মিটবে না। তা ছাড়া আরও বেশি সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশও দেওয়া দরকার।
বাসস্ট্যান্ড সম্প্রসারণের দাবি মেনে নিলেও ব্যাপারে তাঁদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন বাগনান-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নয়ন হালদার। তিনি বলেন, “আসলে বাসস্ট্যান্ড সম্প্রসারণের আর জায়গা নেই। রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কারণ বাড়তি যে জমি দরকার তা রেলের কাছ থেকেই নিতে হবে।” তিনি জানান, বাগনান রেলওয়ে উড়ালপুল চালু হয়ে গিয়েছে। এরই দক্ষিণ দিকে উড়ালপুলের নীচে আরও একটি বাসস্ট্যান্ড তৈরির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা চলছে। তা হলে শ্যামপুরগামী বাস, ট্রেকার এবং অটোগুলিকে ওখানে জায়গা দেওয়া যাবে। তখন বর্তমান বাসস্ট্যান্ডটি অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যাবে।
যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন শাহনওয়াজ এবং নয়নবাবুও। শাহনওয়াজ বলেন, “অন্তত ছয় জন ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা প্রয়োজন।” নয়নবাবুর কথায়, “পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। চারজন ট্রাফিক পুলিশ এবং একটি ট্রাফিক সিগন্যাল দেওয়া হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে।” হাওড়া জেলা পুলিশ সূত্রেও জানানো হয়েছে বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলছে।
তবে এত কিছুর পরেও পরিকল্পনা কতদূর বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে অবশ্য সন্দিহান নিত্যযাত্রীরা। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন যানজটের সমস্যা থেকে বাঁচাতে তাঁদের ভরসা জয়ন্ত পুলিশই।
সোমবার সুব্রত জানার তোলা ছবি।
(চলবে)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর বাগনান’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ,
জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy