এই স্কুলবাড়িতেই দিন কয়েকের ঠাঁই নিয়েছিলেন বাঘাযতীন।
স্টেডিয়াম নেই, খেলা আছে! স্থায়ী সভাঘর নেই! কিন্তু তা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পথে বাধা হতে পারেনি। ঠেক না থাকলেও রয়েছে ভরপুর আড্ডা।
অনেক না পাওয়া, সমস্যাসঙ্কুল অবস্থার মধ্যেও বাগনানের জীবনযাত্রায় যেন আমোদের অভাব নেই। অন্য জায়গা থেকে কাজেকর্মে এখানে আসা মানুষজনকেও যেন ছুঁয়ে যায় শহরের অফুরান প্রাণশক্তির সেই আবেগ। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কখনও খেলাধুলোর মাধ্যমে, কখনও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়, কখনও বা শুধুই আড্ডায়।
অগ্নিযুগের বিপ্লবী বাঘাযতীন (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) ওড়িশার বুড়িবালামের তীরে পৌঁছনোর আগে কয়েকদিন জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন রথতলায় পূর্বতন বাগনান হাইস্কুলের বাড়িতে। ছদ্মবেশ ধরে তাঁকে কোলাঘাটে রূপনারায়ণের তীর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন স্কুলেরই কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র। ইতিহাসের এমন টুকরো টুকরো কাহিনী সারা বাগনান জুড়েই ছড়িয়ে আছে। অবশ্য শুধু ঐতিহ্যের স্মৃতিচারণেই নিজেকে আটকে রাখেনি সে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে আধুনিক জীবনধারার ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে।
ওটি রোড থেকে শুরু করে স্টেশন রোড ধরে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রয়েছে একের পর এক চায়ের দোকান। ভিন্ন ভিন্ন রুচি ও মননের এক মিলনক্ষেত্র এই সব চায়ের দোকানগুলি। শহরে আড্ডা দেওয়ার তেমন কোনও জায়গা না থাকলেও চায়ের দোকানগুলোতে সেই অভাব অনেকটাই মিটিয়ে নেন আড্ডাপ্রিয় মানুষজন। অতীতের কোনও কিছুর স্মৃতিচারণ থেকে হালফিলের রাজনীতি, খেলা কিছুই ব্রাত্য নয় সেখানে। কাপের পর কাপ চা উড়ে যায়। গোটা বাগনান জুড়ে যেন একটা একটা মিনি কফি হাউস। শহরে অচেনা কাউকে আলাপ করতে ডাকলে নির্দিষ্ট চায়ের দোকানের ঠিকানা দেওয়াই যথেষ্ট। নতুন মানুষ ঠিক খুঁজে চলে আসবেন সেখানে।
৫০ বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে আসা স্টেশন রোডের একটি চায়ের দোকানের মালিক রতন ধাড়া বলেন, “একটা সময় আমার দোকান রাজনীতির আলোচনায় গমগম করত। থাকতেন সব দলের সমর্থকেরাই। তবে কোনওদিন তা মাত্রা ছাড়াত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই তর্কবিতর্কের মাঝে পড়ে অনেক খদ্দেরও হারিয়েছি। কিন্তু বুঝেছি, জীবনে পয়সাই সব নয়। মনের খোরাকেরও দরকার আছে। তারও কিছু দাবি থাকে।”
শহরে এমন অসংখ্য চায়ের দোকানেই জমে ওঠে আড্ডা।
শহরের বিভিন্ন ক্লাবে নিয়মিত সাহিত্যবাসর বসে। সাতের দশকের গোড়ায় দেশব্যাপী শুরু হয়েছিল সাক্ষরতার প্রচার ও প্রসারের আন্দোলন। ১৯৭৪ সালে বাগনানের গুটিকয় যুবক গড়ে তোলেন সাহিত্য সংগঠন ‘লিখতে পড়তে শেখান’। সাক্ষরতা আন্দোলনের প্রচারের পাশাপাশি সংগঠনের ছাতার নীচে চলতে থাকে সাহিত্যের অবাধ বিচরণ। সাক্ষরতা আন্দোলন থেমে গিয়েছে, কিন্তু ‘লিখতে পড়তে শেখান’-এর উদ্যোগে এখনও নিয়মিত বসে সাহিত্যবাসর। স্থানীয় কবি সাহিত্যিকদের নিজেকে প্রকাশের ঠিকানা। যেখানে থেকে তাঁরা জোগাড় করেন বেঁচে থাকার রসদ। ‘বসুধৈব উৎস প্রাণ’ পত্রিকার পক্ষ থেকেও প্রতিমাসের প্রথম রবিবার বসে সাহিত্যসভা। টানা সাত বছর ধরে চলা সেই আসরে পা পড়েছে বহু প্রথিতযশা সাহিত্যিকের। সাহিত্যচর্চার এই আবহে এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি একটা স্থানীয় আস্তানার।
সংস্কৃতির আর এক ধারাও বহমান শহরে। রয়েছে সঙ্গীত শিক্ষার অনেক পুরনো প্রতিষ্ঠান। যাদের উদ্যোগে নিয়মিত আয়োজন করা হয় নৃত্য-গীতের আসর। গড়ে উঠেছে ‘সম সংহতি’ নামে সংস্কৃতি সংগঠন। বিভিন্ন জেলার সংস্কৃতি জগতের নবীন প্রতিভাদের বিকাশে গত কয়েক বছর ধরে যাঁরা উল্লেখ্যযোগ্য কাজ করছেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে শহরের বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠনের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সংস্কৃতির এই ফল্গুধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে নাটকও। একসময়ে বাগনানে নাটকের অনেক দল থাকলেও নানা সমস্যায় তার অনেকগুলিই এখন অস্তিত্বহীন। তবে তারই মধ্যে প্রতিবছর রথতলা মাঠে ‘রঙ্গতীর্থ’ আয়োজন করে নাটক প্রতিযোগিতা ও উৎসবের।
সংস্কৃতির দিকে এক পা এগিয়ে থাকলে বাগনানের আর এক পা এগিয়ে খেলায়। বিশেষ করে ফুটবল। এ শহর তো বটেই পাশাপাশি জোকা, খাজুট্টি প্রভৃতি গ্রাম থেকে শহরের বিভিন্ন মাঠে প্রশিক্ষণ নিতে আসেন বহু স্থানীয় খেলোয়াড়। কলকাতায় প্রথম ডিভিশন ফুটবল লিগে খেলার সুযোগ পেয়েছেন এমন বেশ কিছু খেলোয়াড়ের ফুটবলে হাতেখড়ি এখানেই। পূর্বসূরীদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে উপরে ওঠার স্বপ্ন দেখে নবীনেরাও। তারই পথ ধরে শহরে একটি পূর্ণাঙ্গো স্টেডিয়ামের দাবি রয়েছে ক্রীড়াপ্রেমীদের। যার সূত্র ধরে বৃন্দাবন মাঠে স্টেডিয়াম গড়তে কয়েকবছর আগে উদ্যোগী হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে চিঠিচাপাটি দেওয়া হলেও তাদের তরফে কোনও সাড়া মেলেনি। যদিও শহরবাসীর এমন দাবির প্রসঙ্গে উলুবেড়িয়ার সাংসদ সুলতান আহমেদ আশ্বাস দিয়ে বলেন, “গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের টাকায় বৃন্দাবন মাঠে স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া আছে। সে সব মিটলে কাজ শুরু হবে।” আপাতত সে দিকেই তাকিয়ে বাগনানের ক্রীড়াপ্রেমী থেকে সাধারণ মানুষ।
ছবি: সুব্রত জানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy