‘লড়াই’ করছেন তরুণী। মামা হয়েছেন ‘সহযোদ্ধা’!
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে চন্দননগরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সুজলী পাত্র লড়ছেন অসুস্থতার সঙ্গে। তাঁকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে মামা সত্যজিৎ রায় নাছোড়। স্বার্থত্যাগ করতেও পিছপা হননি।
ক্যানসার থেকে সেরে উঠে এ বার পরীক্ষায় বসেছেন চন্দননগরের লালবাগান বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সুজলী। গত ৫ মার্চ ইংরেজি পরীক্ষার পরেই পেটের যন্ত্রণায় ভর্তি হন কলকাতার এনআরএস মেডিক্যালে। পরীক্ষায় তাঁর পেটে টিউমার ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছেন সত্যজিৎ। হাসপাতালেই বাকি পরীক্ষা দিচ্ছেন সুজলী। তাঁর প্রত্যয়, শরীর যতই পরীক্ষা নিক, ছাড়বেন না। ‘সব পরীক্ষা’য় পাশ করবেন।
মা-মরা ওই মেয়ের জন্য হাসপাতালের চৌহদ্দিতেই গাছতলায় কার্যত বিনিদ্র রাত কাটছে মামা সত্যজিতের। ভাগ্নিকে মানুষ করতে বিয়ে-থা করেননি। তাঁকে দেখভালের জন্য জুট মিল শ্রমিকের কাজ ছেড়েছেন। ‘পরীক্ষা’ তাঁরও!
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অর্পিতা মণ্ডলের কাছে অনটনের কথা জেনে কয়েক বছর আগে সুজলীর পড়াশোনা, টিউশনের দায়িত্ব নেয় ‘প্রেরণা’ নামে একটি সংগঠন। মামা-ভাগ্নির পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে চন্দননগর নাগরিক সমাজও। তাদের তরফে বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, হাসপাতালে মামার থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থ-সাহায্য করা হবে। অনেকেই সাহায্য করছেন। একাধিক সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, ‘‘ঠিক হয়েছে, মেয়েটির পরবর্তী চিকিৎসা এবং পড়াশোনার প্রয়োজনে ওর পাশে আমরা থাকব।’’ প্রেরণা-র সদস্যেরাও মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন সুজলীদের
পাশে দাঁড়ানোর।
প্রৌঢ় সত্যজিৎ জানান, সুজলী ১১ দিন বয়সে মাতৃহারা হয়। তার বাবা অন্যত্র সংসার পাতেন। মামাবাড়িতেই সুজলী মানুষ। দাদু-দিদিমার মৃত্যুর পর থেকেই মামা-ভাগ্নির সংসার। ’২২ সালে মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করেন সুজলী। তিনি জানান, এর পরে ডান ওভারিতে (ডিম্বাশয়) টিউমার ধরা পড়ে। ’২৩ সালের জুনে এনআরএসেই অস্ত্রোপচার হয়। ধরা পড়ে ক্যানসার। ’২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ২৮টি কেমোথেরাপি হয়। পুরোপুরি সেরে ওঠেন তিনি ওই বছর উচ্চ মাধ্যমিক অবশ্য দিতে পারেননি।
এ বার উচ্চ মাধ্যমিকের কয়েক দিন আগে পেটে ব্যথা শুরু হয়। পেট ফুলে যায়। হাসপাতালেই পুষ্টিবিজ্ঞান এবং কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন পরীক্ষা দিয়েছেন। আজ, সোমবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষা রয়েছে। কাল ভূগোল। চন্দননগরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাঁতরাপাড়ায় সরকারি-প্রকল্পের বাড়িতে থাকেন তাঁরা। সত্যজিৎ বাড়ি না-যাওয়ায় হাসপাতালে বইপত্র আনা হয়নি। সহপাঠীরা মোবাইলে ‘নোট’ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাতেই চলছে সুজলীর পরীক্ষার প্রস্তুতি। চিকিৎসক-নার্স, অন্য রোিণীরা উৎসাহ জোগাচ্ছেন।
সত্যজিতের কথায়, ‘‘জমানো টাকায় কোনও রকমে আমাদের চলছে। আমার বাবাও গোন্দলপাড়া জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। আজও বাবার গ্র্যাচুইটি পাইনি, মামলা চলছে। হকের টাকাটা পেলে কাজে লাগত।’’ সুজলী বলেন, ‘‘বড় হয়ে চাকরি করতে চাই।’’
এগিয়ে চলতে চায় মামা-ভাগ্নির সংসার। সব প্রতিবন্ধকতাকে
হেলায় হারিয়ে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)