স্কুলের টিচার্স রুমে ঢুকে শিক্ষকদের বেধড়ক মারধর ছাত্রের মামার। — নিজস্ব চিত্র।
স্কুলে শাসন থাকবে না— এটা নেহাতই ভুল ধারণা। মনে রাখা দরকার, ‘‘শাসন করা তারই সাজে, যে ঢেলে দেয় সোহাগ স্নেহ।’’ শাসন আর সোহাগের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে৷ কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, শাসন শব্দটিকে বিদ্যালয়ে আমরা ভুলিয়ে দিতে চাইছি।
আমি মনে করি, বিদ্যালয়ে কঠোর শাসন থাকা উচিত৷ যে অভিভাবকেরা শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষককে শাস্তি দিচ্ছেন, অপমান করছেন— তাঁরা আসলে ভুলে গিয়েছেন অতীত দিনের কথা৷ তাঁরা নিজেদের শৈশবের দিকে ঘুরে তাকাতে চান না৷ তাঁরা যদি নিজেদের শৈশবের স্মৃতির বাক্স যদি খুলে দেখেন, তা হলে হয় তো তাঁদের মন বদলাতে পারে!
ছোটবেলায় ভাবতাম, বেতের চোখ আছে৷ সে দেখতে পায়৷ হেডস্যার সুধীরবাবু যদি বেতটা তুলে নাড়াতে নাড়াতে বলতেন, ‘‘বল কে অন্যায়টা করেছিস? আমি সব জানি, শুধু তোদের মুখে সত্যিটা জানতে চাইছি’’— যে দোষ করেছে, সে যেন সম্মোহিতের মতো নিজের দোষ স্বীকার করে নিত৷ তারপরে তার কপালে যা প্রহার জুটত, বলার নয়৷ এই শাস্তির বিপক্ষে বলতে বাবা-মা, পাড়াতুতো হিতাকাঙ্খীরা ছুটে আসেননি৷ বরং অপরাধের কথা জানতে পারলে বাড়িতে বড়রা আরও কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়েছেন পিঠে৷ এ সব নিয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কাউকে দেখিনি। তবে হ্যাঁ, প্রহারের মধ্যে ‘হার’ শব্দটি আছে৷ প্রহৃত ছাত্রের সমান কষ্ট অন্তরে না বাজলে, শিক্ষকের হার হয় ছাত্রের অন্যায়ের কাছে৷
সে সময় স্কুলে শাস্তির নানা প্রকার ছিল। চড়, চিমটি, গাঁট্টা, চুল ধরা, কানমলা, চেয়ার-ডাউন, নিলডাউন, বেঞ্চের উপরে দাঁড়ানো, একপায়ে কান ধরে দাঁড়ানো, মাঠে পঁচিশ পাক ছোটা ইত্যাদি৷ এক মাস্টারমশাই পেটে চিমটি কেটে বলতেন— ‘মোচড়ে মোচড়ে মধু ঝরে’৷ সে ‘মধু’র জ্বালা সারা দিন থেকে যেত৷ মাস্টারমশাইরা ভয়, ভালবাসা মাখা সম্ভ্রম আদায় করে নিতেন৷ কিন্তু, যে দিন থেকে ভাবা শুরু হয়েছে, মাস্টারমশাইরা অভিভাবক নন, তাঁরা শুধু শিক্ষা দেওয়ার যন্ত্রমাত্র— সে দিন থেকেই শুরু হয়েছে এমন অধ্যায়!
আমার বাবাও শিক্ষক ছিলেন। সেই স্কুলেই পড়েছি। আমার দীর্ঘ শিক্ষকতাও সেখানে। বাবা বলতেন, পাঁচ বছর পর্যন্ত লালন করতে হয়। দশ বছর পর্যন্ত শাসন, প্রহার। ষোল বছর পেরোলে বন্ধু ভাবতে হয়৷ হেডমাস্টারমশাই বা কোনও অন্য শিক্ষক গম্ভীর ভাবে হেঁটে এলে, সমস্ত ক্লাস চুপ। আবার, তাঁরাই ছাত্রদের মুখ দেখে ঠিক বুঝতে পারতেন, কে বাড়িতে খেয়ে আসেনি৷ ক্লাসে পড়াশোনা করা ছেলেরা তো মাস্টারমশাইদের প্রিয় ছিলই। কিন্তু সব থেকে দুষ্টু বা বদ ছেলে হত শিক্ষকদের বেশি প্রিয়৷ তারা পিটুনি খেয়েছে, আবার মানের বালাই ভুলে স্কুলের যত কাজে এগিয়ে এসেছে সবার আগে৷ মাস্টারমশাইরা ছাত্রছাত্রীদের মন পড়তে পারতেন৷
মানুষ গড়ার কারখানায় শৃঙ্খলা থাকবেই৷ মাস্টারমশাইদের শাসন, প্রহার, ভালবাসা দিয়ে ছাত্র গড়তে হয়৷ বহিরাগতদের তাণ্ডব সে কাজে বাধা হলে সমাজে শৃঙ্খলা থাকতে পারে না৷ ছাত্র প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে না৷
আজ যাঁরা বলছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাস্তি দেওয়া যাবে না, সামান্য শাস্তি দিলে মাস্টারমশাইকে নাজেহাল করছেন— তাঁরা আগামী পৃথিবীর জন্যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন৷ বুঝতে চাইছেন না, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হচ্ছে ঘরে ঘরে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy