ঘটনার তিন দিন পরেও ধস অব্যাহত হাওড়ার বেলগাছিয়া ভাগাড়ে। অব্যাহত স্থানীয় বাসিন্দাদের আতঙ্কও। ধসের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভাগাড়ের ঠিক পিছনে ঝিলের ধারের ১৫ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি। একাধিক বাড়ি ভেঙে পড়েছে। কংক্রিটের রাস্তা ভেঙে ১০ ফুট উঁচুতে উঠে গিয়েছে। বিষাক্ত মিথেন গ্যাসের গন্ধে ভরে গিয়েছে আশপাশের অন্তত আধ বর্গকিলোমিটার এলাকা। অথচ, ঘটনার পরে তিন দিন কেটে গেলেও ওই এলাকা থেকে সমস্ত বাসিন্দাকে অন্যত্র সরানো হয়নি। হাওড়া পুরসভার দাবি, পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুক্রবার মাঝরাতে ঝিলের ধারের এফ রোড থেকে কিছু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্য দিকে, শনিবার মধ্য হাওড়া ও শিবপুর বিধানসভা কেন্দ্রের ওয়ার্ডগুলিতে জল সরবরাহ শুরু করা হলেও উত্তর হাওড়ার ১৪টি ওয়ার্ড এ দিনও ছিল নির্জলা। পুরসভার চেয়ারপার্সন সুজয় চক্রবর্তীর দাবি, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বেনারস রোডে নতুন পাইপলাইন জোড়ার কাজ চলছে। সোমবার থেকে উত্তর হাওড়ায় জল সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে বেলগাছিয়া ভাগাড়ের ১০-১৫তলা উঁচু আবর্জনার পাহাড়ে আড়াআড়ি ফাটল ধরে। যা বড়সড় ধসের আকার নেয়। ধসের জেরে ভাগাড়ের ভিতরে উত্তর হাওড়া, শিবপুর ও মধ্য হাওড়ার একাংশে পানীয় জল সরবরাহকারী মূল পাইপলাইন ফেটে যায়। ফাটল ধরে কোটি টাকা ব্যয়ে সদ্য তৈরি কংক্রিটের রাস্তায়। ভেঙে পড়ে সদ্য তৈরি করা নিকাশি নালাও। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঝিলের ধারে এফ রোডের বস্তির বহু বাড়ি ও ঝুপড়ি। ধসের জেরে প্রথমে বহু বাড়িতে ফাটল ধরলেও সেই ফাটল বাড়তে থাকে শুক্রবার সকাল থেকে। ভেঙে পড়তে থাকে একের পর এক টালির চালের অস্থায়ী বাড়ি। মিথেনের কটু গন্ধে বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কংক্রিটের রাস্তা এক জায়গায় প্রায় ১০ ফুট উঁচুতে উঠে গিয়ে পাহাড়ের ঢালের মতো নেমে এসেছে। হেলে পড়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের এক জোড়া খুঁটি। আগের দিন কংক্রিটের রাস্তায় যে ফাটল এক ইঞ্চি চওড়া ছিল, এ দিন তা ১২ ইঞ্চি হয়ে গিয়েছে। বাসিন্দারা জানান, শুক্রবার রাতে আরও কয়েকটি বাড়ি ভেঙে পড়েছে। অনেকের ঘরের মেঝে ভেঙে নীচে ঢুকে গিয়েছে। সেই সমস্ত ভেঙে পড়া বাড়ি থেকে বাসিন্দারা শেষ সম্বলটুকু বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থানীয় লিলুয়া থানার পুলিশ মাইকে ধসপ্রবণ এলাকা থেকে সরে যাওয়ার আবেদন জানিয়েই দায় সারছে। আতান্তরে পড়া পরিবারগুলি কী খাবে, কোথায় থাকবে, তা নিয়ে এ দিনও প্রশাসনের আধিকারিকদের মধ্যে হেলদোল দেখা যায়নি। ভাঙা বাড়ি থেকে জিনিসপত্র সরিয়ে এনে রাস্তার ধারে বসে ছিলেন গীতা দাস, পুতুল দেবী, সুরুলিয়া পাসোয়ানেরা। তাঁরা বললেন, ‘‘আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা যাব কোথায়? খাব কী?’’
এ দিন ভাগাড় সংলগ্ন এফ রোড এবং ঝিলের ধারে ঘুরে দেখা গেল, ভাগাড়ের আবর্জনা থেকে বায়ো-মাইনিং এবং বাড়ি বাড়ি পানীয় জল সরবরাহের উপরে যতটা জোর দেওয়া হচ্ছে, ধসের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের নিয়ে ততটা ভাবা হচ্ছে না। অথচ, ভূতত্ত্ববিদেরা জানাচ্ছেন, বেলগাছিয়া ভাগাড়ের যা পরিস্থিতি, তাতে সংলগ্ন এলাকায় মিথেন গ্যাসের বিষ মাটির নীচে অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে। যে কোনও সময়ে আরও বড় ধরনের ধস নামতে পারে। ভূতত্ত্ববিদ সুজীব কর বললেন, ‘‘ভাগাড়ের দূষিত পদার্থ মাটির নীচের ফাঁকা অংশে জমা হচ্ছিল। জমতে জমতে মাটির নীচে মিথেন গ্যাস প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয়েছে। যে হেতু মিথেন গ্যাস ফেটে বেরিয়েছে, তার ফলে সেখানকার মাটি হালকা হয়ে গিয়েছে। এখন ওই গোটা এলাকাই ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’’
পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, তা মানছেন হাওড়া পুরসভার চেয়ারপার্সন। তিনি বলেন, ‘‘নবান্নে গিয়ে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জেলাশাসক। ওই এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ বা আইআইএসটি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হচ্ছে। তাঁরা এলাকায় ঘুরে রিপোর্ট দেওয়ার পরেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)