জীবন-সংগ্রাম: জলমগ্ন খানাকুলের কাকনানের কালীতলা এলাকায় চলছে শুকনো খাবার বিতরণ (বাঁ দিকে) পানীয় জল ও খাবার নিয়ে বাড়ির পথে। জয়পুরে (ডান দিকে) ছবি: সঞ্জীব ঘোষ ও সুব্রত জানা
উঠোনের সজনে গাছটা আস্ত আছে। বাড়িতে প্লাবনের জল ঢোকার আগে রেশনে পাওয়া ১০ কেজি চাল নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রেখেছিলেন খানাকুলের বন্দর গ্রামের অপর্ণা জানা। সেই শাকসেদ্ধ আর ভাত খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। উঠোন ছোঁয়া প্লাবনের জলে বাসন ধুতে ধুতে শুক্রবার তাঁর ক্ষোভ, ‘‘এখনও কোনও সরকারি ত্রাণ পাইনি।’’
এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ভিভিসি-র ছাড়া জলে প্লাবিত হয় হাওড়ার আমতার ঘোড়াবেড়িয়া গ্রামও। সেখানকার হারুন রশিদের গলাতেও এক সুর, ‘‘বন্যা হওয়ার পর থেকে এই এলাকার বেশিরভাগ পরিবার এক ফোঁটা সরকারি ত্রাণ পাননি। মানুষ খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছেন।’’
দুই জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আর অবনতি হয়নি। কিন্তু ত্রাণের দাবি জোরাল হচ্ছে। আমতার সেহাগড়িতে বন্যা দেখতে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বন্যার্তদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘‘সরকারের তরফ থেকে ত্রাণের কোনও সমস্যা হবে না। সরকার তাঁদের পাশে আছে।’’ অথচ, প্লাবনের প্রায় এক সপ্তাহ পরে ত্রাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বহু বানভাসি মানুষ।
প্লাবনে হুগলিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয় খানাকুল। এখানকার দু’টি ব্লক থেকে জল এখনও নামেনি। দোকান-বাজারও ডুবে রয়েছে। ফলে, ক্ষমতা থাকলেও কেনাকাটা করতে পারছেন না গ্রামবাসী। খানাকুল-২ ব্লকের ২৪টি পঞ্চায়েতেই ত্রাণের দাবিতে মানুষ ফুঁসছেন। বন্দর গ্রামের অপর্ণার ক্ষোভের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে ঘোড়াদহের সুমন্ত মালিক, কাগনান গ্রামের বিমল রায়ের গলাতেও। ত্রাণের অপ্রতুলতার কথা মানছেন শাসক দলের স্থানীয় নেতারাও।
খানাকুল-২ ব্লকের শাবলসিংহপুর পঞ্চায়েতের প্রধান, তৃণমূলের ইকবাল হোসেন খানের অভিযোগ, ‘‘এই এলাকায় প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা। সকলেরই ত্রাণ প্রয়োজন। পেয়েছি মাত্র ৬০ বস্তা চাল, ৬ বস্তা চিঁড়ে, আর দু’টিন গুড়। প্রত্যেককে যদি ৫ কেজি করে চাল দিই, ৬০০ জন পাবেন।” ধান্যগোড়ি পঞ্চায়েতের ৮ নম্বর সংসদের সদস্য সুজাতা পাত্রের অভিযোগ, তাঁর এলাকার প্রায় ৯০০ মানুষ এক দানা ত্রাণ পাননি।
যে সব জায়গায় সরকারি ত্রাণ আসছে, সেখানে বিলিবণ্টনে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। এ জন্য সর্বদলীয় কমিটি করার দাবি তুলেছেন গ্রামবাসী। একই দাবি বিজেপি এবং সিপিএমের। খানাকুলের বিজেপি বিধায়ক সুশান্ত ঘোষের অভিযোগ, “এখানে সব ক’টি পঞ্চায়েতেই তৃণমূলের বোর্ড। পঞ্চায়েত সদস্যেরা সরকারি ত্রাণ অধিকাংশই দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেই বিলি করছেন।” অভিযোগ মানেনি তৃণমূল।
জেলাশাসক (হুগলি) দীপাপ্রিয়া পি জানান, কোথাও ত্রাণের অভাব হওয়ার কথা নয়। অভিযোগও মেলেনি। আজ, শনিবার খানাকুলে গিয়ে তিনি পরিস্থিতি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এ পর্যন্ত হুগলির প্লাবিত এলাকায় সব মিলিয়ে ৩০০ টন চাল, ১২ হাজার কেজি চিঁড়ে, ৩ হাজার কেজি শিশুখাদ্য এবং ১০ হাজার পোশাক পাঠানো হয়েছে।
আমতায় ত্রাণের দাবি বেশি শোনা যাচ্ছে ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান পঞ্চায়েত থেকে। নদীঘেরা এলাকাটি জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। রূপনারায়ণ এবং মুণ্ডেশ্বরীর সাঁড়াশি আক্রমণে প্লাবিত হয়েছিল। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। কিন্তু মুণ্ডেশ্বরীতে প্রবল স্রোত থাকায় নৌকা চলাচল সরকারি ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে, গ্রামবাসীরা শহর থেকেও যে কিছু সংগ্রহ করে আনবেন, তারও উপায় নেই। এখানকার বহু গরিব মানুষ বর্তমানে পড়শির বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা জানান, এই অবস্থায় সরকারের দেওয়া শুকনো খাবার তাঁদের খুব দরকার ছিল। কিন্তু তা না আসায় তাঁরা হতাশ। বাড়িতে থাকা চাল-ডাল ফুটিয়ে দিন চলছে।
গ্রামবাসীর সমস্যা দূর করতে মুণ্ডেশ্বরীর ধারে কুলিয়ায় ব্লক অফিসের একটি অংশকে তুলে এনে বসানো হয়েছে। তার পরেও ত্রাণের দাবি উঠছে। শুক্রবার উলুবেড়িয়ার মহকুমাশাসক শমীক ঘোষের নেতৃত্বে ব্লক প্রশাসনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল স্পিড বোটে করে এই এলাকায় যান। নদী তীরবর্তী কিছু এলাকায় ঘুরে মানুষজনের মধ্যে চিঁড়ে, চিনি, শিশুখাদ্যের প্যাকেট বিলি করে দলটি। মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘এই এলাকায় আরও সুষ্ঠু ভাবে ত্রাণ বিলির জন্য নানা পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy